Tuesday, December 24, 2019

রাজদীপ্ত রায়





জাংকইয়ার্ড ## ২৩

আমি একটা হেলাফেলার মানচিত্র পেয়েছিলাম রাস্তায়। ধুলোয়। কোণা ছেঁড়া। অস্পষ্ট। শুকিয়ে যাওয়া কান্না আর কিছু রক্তের দাগ ছড়িয়ে ছিলো তার বুকের ওপর। হালকা শিরা উপশিরার মতো জালিকাময়। অথচ জীবন্ত। শুধু, কথা বলতে পারে না।

আমি ধুলো ঝেড়ে তুলে নিলাম হাতের চেটোয়। তুলোট কাগজের মতো মানচিত্র। অনেক অনেক দিন ঝড় জলে পড়ে থাকা হাড় হাভাতে রোগা ভোগা চেহারা। ভাঁজ হলে ভাঙার সম্ভাবনাও ছিলো প্রবল। পেটে প্রকাণ্ড উনুনের ক্ষিধে। কিন্তু স্পর্শে এলে বুঝলাম, প্রাণ এখনো আছে কিছু বাকি। গোপন অতীত আর অপরাধী স্মৃতির মতো নাছোড়বান্দা প্রাণ। শুধু, কথা বলতে পারে না।

বসার ঘরে তুলে নিয়ে এলাম তাকে। এখন আমার একটাই কাজ। দিন রাত সে তুলোট দেখি, ধরি, আর ছেনে ঘেঁটে সাজিয়ে তুলি। টেবিল এলো। উঁচু চারপেয়ে জলচৌকির ওপর তামার টাটে ঠাঁই হলো তার। ওপরে পড়লো মখমলি এল-ই-ডি আলো। হতে পারে কাগুজে, কিন্তু আসলে জীবন্ত কি না। চারপাশে কাঁচ পড়লো। সীমানা হলো। ঘেরাটোপের আই-সি-ইউ হলো। মোটমাট, পার্থক্য একটা হলো। বিড়ম্বিত, কিন্তু নিশ্চিত পার্থক্য। শায়িত মানচিত্রের দেহ দেউল বরাবর। কৃষ্ণের জীব বলে কথা। প্রাণে বাতাস লাগলো। শুধু, কথা বলতে পারে না।

খেলাটা জমে উঠলো এর অনেক পরে। আমার নাওয়া খাওয়া বিদেয় হলো মানচিত্রের চিন্তায়। কাজে যাই, বেড়াতে যাই, বাজারে যাই, কিন্তু স্বস্তিতে থাকতে পারি না। মন পড়ে থাকে আলোর নিচে রাখা ছেঁড়া সীমানার মানচিত্রের ওপর। যত্ন পেয়ে আজকাল তার গায়ের শিরা উপশিরায় গত্তি লেগেছে কিছুটা। অনুভবে সজল গন্ধ। ইশারায় টাপটুপ ভরে ওঠা। আমি দোকান ঘুরি। মলে যাই। ধুলো ঝাড়ার ঝাড়ন কিনি। কিনি তুলোট কাগজের মানানসই কালি ও কলম। তিলতিল করে সাজিয়ে তুলি মানচিত্র। মনের মতো দাগে আর দরবারে। দেশ আঁকি। আঁকি জাতি। ফল ফুল দুব্বোঘাস আর ইতিহাস। নিজের ইচ্ছে মতো। আঁকি কাঁটাতার। বিভেদরেখা। বসত ও বেঁচে থাকা বরাবর। 

কিন্তু, রোঁয়া ওঠা তুলোট মানচিত্রে সব রঙই গা-ছাড়া ছানার মতো হয়ে থাকে। কাগজে লাগে না। অথচ কান্না আর রক্তের পুরনো দাগগুলো আঁটো হয়ে বসে থাকে তুলোটের গায়ে। মুছলেও ওঠে না। তাদের একদিকে স্মৃতিচিহ্ন লেখা থাকে। অন্যদিকে ভবিতব্য। তারা নড়ে চড়ে, একে অন্যকে জড়িয়েও ধরে। শুধু, কথা বলতে পারে না।

আমার রোখ চেপে যায়। যতক্ষণ রাস্তায় পড়ে ছিলি, হতচ্ছেদ্দায়, আমি কিছু ভাবিওনি, বলিওনি। কিন্তু এখন মানচিত্র আমার সম্পত্তি। অত ওজর শুনবো কেন। আর তাছাড়া, আমি কি সংখ্যা, শুধুই সংখ্যা। আমারোও কি মন নাই, মানচিত্র! 

অতএব, আমি আরোও রঙ আনি। গাঢ় রঙ। সাঁজোয়া গাড়ির কনভয় দিয়ে ঘিরে ফেলি গররাজী মানচিত্রের দিকচক্রবাল। কেশরীয়া বালমের কোল ঘেঁষা আশমানী গূঢ়তায় ছুপিয়ে তুলি তুলোটের আপাদমস্তক। ভর সন্ধেবেলায়। জ্যান্ত মানচিত্রের দেহজ অনুযোগ অস্বীকার করি। তাকে নূপুর পরাই। সাধের চলনে বেঁধে দিই নিজস্ব সুর তাল লয়। ভালোবাসি। আদর করি। সভা বসাই নিক্তি মেপে। নবরঙ্গ গুহ্যজ্ঞানে। নির্বাচিত প্রতিনিধি ঠিক করি মহাকাব্যিক প্রত্যয়ে। রাষ্ট্র গড়ি একটু একটু করে। রাষ্ট্রীয় গড়ি। দপ্তরের কানে দিই নিষ্কাম মন্ত্র। 

বিজয়ীর উল্লাসে আমি এক এক করে বিলি করি মন্ত্রকের ভার। জলে আর রঙে ভেজা মানচিত্রের সমস্ত প্রতিরোধ আলোর নিচে পড়ে থাকে। বাধা দেয় অসহায় ভাবে। আধমরা মোচড় আর কাঁপনগুলি অসাড় হয়ে আসে। জলচৌকির ওপর। 

সমস্ত খেলা পালটে দেওয়ার নেশায় আমি ধরাকে বলে ফেলি সরা। মানচিত্রকে মেপে নিই হেঁট মুণ্ড উর্দ্ধ পদে। পল্লি সাজাই। সাজাই গ্রাম নগর জনপদ কেন্দ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠান আর ডিটেনশন ক্যাম্প। আইন জারি করি। বাঁটোয়ারা করি দায়িত্ব। বিচার ব্যবস্থাকে অব্যাহতি দিই। সন্ত্রাসী লোলুপ হাতে তুলে দিই পায়রা প্রতীক। দরপত্রে হেঁকে দিই নৈতিক স্বরাষ্ট্র ভার। শপিং মলে সাজিয়ে রাখি কৃষকের মৃতদেহ। আর বিদ্যালয়ের মুখ বরাবর অভ্যেস করি হেম সেলাইয়ের সূচীশিল্প। এসবই আমি করে ফেলি নিখুঁত পেশাদার ঢঙে। অতিদ্রুত। টুঁ শব্দটি ছাড়াই। কেননা, মানচিত্র কথা বলতে পারে না।  

এহেন অভিনব সাজ সজ্জা অতিরেকে মানচিত্র যে বড় শান্ত ছিল এমন নয়। কিন্তু তার নড়াচড়ায় বিশেষ আমল আমি দিইনি। শত হোক জীবন্ত তো। ওটুকু হেলদোল হবেই। একটা একটা করে উপড়ে নিই কান্না আর রক্তের দাগ। স্মৃতি আর ভবিতব্য ঘুলিয়ে তুলে মানচিত্রকে করে তুলি বেমক্কা অপরিচিত। 

কিন্তু যেই না সিংহাসনে বসিয়ে ফেলি এক গণহত্যার গোঁসাই, আর তার হাতে তুলে  দিই কাঁটাতারের রাজ্যপাট, অমনি উদ্ভট কাণ্ডটা ঘটে গেলো আচমকা। আমায় অবাক করে কথা বলে উঠলো ছেঁড়া কিন্তু জ্যান্ত মানচিত্র। কী আশ্চর্য তার অকৃতজ্ঞ শব্দ দুর্মতি। ক্লান্ত অথচ স্পষ্ট গলায় আমাকেই কিনা ডেকে বললো, ইতর! বেজন্মা!



No comments:

Post a Comment