Tuesday, December 24, 2019

শতানীক রায়





একটি ফ্যাসিজম সংক্রান্ত আলোচনা


Calm in action. As a waterfall becomes slower and more floating as it plunges, so the great man of action will act with greater calm than could be expected from his violent desire before the deed.
                       —Man Alone With Himself,
                        Friedrich Nietsche.   

এই উক্তিটাকে আমি বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রনেতার জন্য প্রযোজ্য বলে মনে করি। তিনি যে মহান একজন মানুষ তা ওনার কর্মে এবং আচরণে ফুটে ওঠে তা একটা নদীর মতো প্রথমে এত উচ্ছ্বাস তবে কাজেই ধীর প্রাবল্যে দেশের সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ। ভায়োলেন্ট ডিজায়ার।
ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরোধী এই মুহূর্তে আমার সামনে একমাত্র পথ হিসেবে মনে হচ্ছে, এমন একটা উইসডমে পৌঁছানো যেখান থেকে সমস্ত উত্তর সত্যের ঘোর কেটে বেরোনো যাবে। এটা একটা করুণ সত্য যে, এখন যা কিছুই দেখছি সবটাই রাষ্ট্রশক্তির তৈরি করা জগৎ। আমাদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। চরম বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছি। যে-কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তি চায় নিজের নামকে আরও বেশি ছড়িয়ে দিতে। ফ্যাসিজম থেকে পপ্যুলিজম। নিজের মুখটা কীভাবে কেটে ছেটে বা বড়ো করে রং চাপিয়ে মানুষকে বোঝানো যায়: এই দেখো এটাই সত্যি এটাই ট্রেন্ড যার থেকে একটা এমন পক্ষে-বিপক্ষের যুগ শুরু যেখানে উভয়ই বিক্ষিপ্ত হচ্ছেন মূল সত্য থেকে এমনভাবেই সরে যাচ্ছেন যার পর আর ব্যূহ ভেদ করে বেরোনোর রাস্তা থাকছে না।
       ফ্যাসিজম শব্দটার ১৯১৯ সালের আগে কোনো অস্তিত্ব ছিল। এমনকী ফ্যাসিজম শব্দটা রাজনৈতিক হলেও একঅর্থে কোনো ভিত্তি নেই কারণ আরও বেশি সঠিক শব্দগুলো হল, dictatorship, brutal এবং এরকম আরও কিছু শব্দ আরকী। ১৯১৯ সালের 'ইতালিয় ফ্যাসিজম' হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে খারাপ ফলাফল। এটাকে আমি একটি জিওপলিটিক্যাল শব্দ হিসেবেও বলতে পারি। এভাবেও ঠিক সরলীকরণ করলে হবে না। একটা সময় ছিল যখন anti-Semitism বলে একটি প্রবহমান ধারণা প্রচলিত ছিল বিশ্বে। তবে অনেকদিন হল ইসলামোফোবিয়া এই প্রক্রিয়া থেকে পাশ্চাত্যের চিন্তার দিক পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমি জোর গলায় না বললেও বলব, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। Enzo Traverso তাঁর বই 'New Faces of Fascism Populism and The Far Right' বইতে লিখছেন: 'The most significant similarities between today’s Islamophobia and the older anti-Semitism probably concern the German Reich of the end of the nineteenth
century, rather than the French Third Republic.' বর্তমান ভারতেরও এই একই সমস্যা। এই সমস্যা একটি বৃহৎ গুরুতর বিষয়।

আমরা চারদিকে বিব্রত ও বিরক্তির শিকার হচ্ছি। এতে কোনো ভুল নেই যে, বর্তমানে ভারতে ফ্যাসিজম নেই। পাশাপাশি আরও অনেক কিছু মনে করতে হবে। যে-সব যুক্তি ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে  'ক্যা' (CAA) এবং এন আর সি (NRC) নিয়ে সেগুলো সম্পর্কে বেশিরভাগ ভারতীয় নাগরিকই বিভ্রান্ত। আর মনে রাখতে হবে যখন অধিকাংশ ভারতীয়ের সঠিক শিক্ষার অভাব। এ দেশে একমাত্র অস্ত্র হল কুসংস্কার ও ধর্ম নিয়ে সম্প্রদায়ের সংস্কার দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব। তপন রায়চৌধুরী বছর পাঁচ-ছয় আগে অনুষ্টুপ পত্রিকায় একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন এ বিষয়ে। যে-দেশে আমি বারবার বলি, ভারতের মূল সমস্যাই হল সংস্কৃতির ঘেরাটোপ থেকে মানুষ বেরোতে পারে না। আমি এটা বলছি না যে, সংস্কৃতি বিমুখতা এর উপায়। সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সংস্কারে অংশগ্রহণ করেও তার থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। ভারতে এমন একটা কালচারাল ল্যাবিরিন্থ কাজ করে সেটা একমাত্র একজন ভারতীয়ই অনুভব করতে পারেন। এমনকী গোপনে অন্তর্ভুক্ত ধর্মীয় হিংসা এমনভাবে গেঁথে গেছে আমাদের ভেতর যে-জন্য আরও বেশি করে রাষ্ট্রশক্তিগুলো সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার। ইউরোপ একটা সময় ইহুদিদের নিয়ে হিংসা ছড়িয়েছে। তবে এখন বর্তমানে প্রায় পুরো বিশ্বেই ফ্যাসিজম চালানো হচ্ছে Racism আর Islamophobia-র উপর ভর করে।               
        আমার একটা বড়ো প্রশ্ন এখানে যে, এই বর্তমান সরকার যাঁরা একটি নির্দিষ্ট দলীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী সেটা সম্পর্কে বেশিরভাগ ভারতীয় অবগত ছিল। এর সাক্ষী ইতিহাস আছে। গুজরাত এর চরম সাক্ষী। বাবরি মসজিদ এর সাক্ষী। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের আস্ত একখানা গল্প আছে 'ভারতবর্ষ' এই হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নিয়ে। যা একদম সরাসরি না হলেও আকারে ইঙ্গিতে বাস্তবটাকে উজার করে তুলে ধরে আমাদের সামনে। এতে কোনো ভুল তো নেই-ই বরং এই সর্বসাধারণের কাছে সমস্ত কিছু পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও এই দেশের জনগণ এমন একটা দলকে আবার পুনরায় পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করে রাষ্ট্রের প্রতিভূ করে তুলল। যেখানে প্রমাণিত হয়েছে Demonetization চরমতম ভুল এই সরকারের। আমরা কেউ বোঝার আগেই দেশের মানচিত্র বদলে গেল রাতারাতি। কোনো অংশেই মেনে নেওয়া সহজ নয় দেশের সর্বত্র এমন ছড়াতে থাকা বিভ্রান্তি এবং অশান্তি। যেখানে প্রতিবাদ মিছিলকে রোখার জন্য সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি করা হচ্ছে যাতে মিছিল জড়ো হওয়ার আগেই ছত্রভঙ্গ করা যায়। পাশাপাশি ভয় অন্য জায়গায়। দেশের এরকম অশান্তকর পরিবেশে নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর দালালদের কারবার আরও সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠে। সবার আগে মনে রাখতে হবে অনুরাগ তো অবশ্যই ছিল। যারা ভোট দিয়ে এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে এনেছে আর যারা তাদের ভোট দেননি উভয়েই এরকমভাবে বা অন্যভাবে বর্তমান দলেরই সমর্থন করে এসেছেন। মনে রাখতে হবে Will to power. হেগেল একটি উক্তি করেছিলেন একসময়: 'What is well-known is not necessarily known merely because it is well-known.' বর্তমান চিত্রের সঙ্গে এর তীব্র সামঞ্জস্য আছে। নীৎশের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর বই 'Will to Power'.  সেখানে নিহিলিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আদর্শকে আবিষ্কার করা, পরখ করে দেখা আর নতুন আদর্শ বা মতাদর্শের তৈরি হওয়া এই কথা বলেছি। এই বইয়ের শুরুতেই নীৎশে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন: tortured tension. এই বইটি বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক গসপেল হিসেবে মানতে পারি আমরা। একটা সময় ছিল ইউরোপে ফ্যাসিজম গড়ে উঠেছিল কম্যুনিস্ট মতাদর্শের ওপর নির্ভর করে। যার ফলে আমরা লক্ষ করি হিংসা আর মৃত্যু।                   
        আর্থার কোয়েস্টলার 'The God that Failed' বইতে একটি লেখার শুরুটাই এভাবে করছেন: 'A faith is not acquired by reasoning. One does not fall in love with a woman, or enter the womb of a church, as a result of logical persuasion.' মানুষ রাষ্ট্রের বর্তমান শাসকদলের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিল এই ব্যাসিক ইনস্টিংকট থেকে যে, হয়তো এরা দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির জন্য কাজ করবে। তবে কে জানত 'ভারতের অচ্ছে দিন' যে এভাবে আসবে! একটা রাষ্ট্রের মানুষ দুটো জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন:  'Devotion to pure Utopia, and revolt against a polluted society, are thus the two poles which provide the tension of
all militant creeds.' আমরা সবসময়ই এমন একটা দেশের কামনা করি যেখানে সবকিছু ঠিক হবে। এটা কখনোই সম্ভব হয় না। এভাবে হতাশ হওয়ার পর মানুষ আস্থা হারায়। আর এমন এক আস্থাহীন সময়ে আমাদের দেশে জাতি ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে অনেকটাই সফল রাষ্ট্রনেতারা। এদের মধ্যে একজন গান্ধীর হত্যাকারীকে সমর্থনও করেছেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিচ্ছু নেই। ফ্যাসিজম এভাবেই চলে। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি দেশের মানুষের প্রগতিশীল সময়টাকে কীভাবে নষ্ট করা হচ্ছে। আর একটা সময় যখন এই সম্পূর্ণ ঘোর থেকে বেরিয়ে আসব লক্ষ করব অনেকটা বছর পেরিয়ে গেছে।
        হিটলার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নাজী বর্বরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শিশুরা। ইহুদী শিশুরাই বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছিল। জাতি ও দেশ নির্বিশেষে তাদের হত্যা করা হয়। পশ্চিম ইউরোপে ইহুদী নির্যাতনের সঙ্গে শিশুদের ওপর জঘন্য সন্ত্রাস চালানো হয়। কিন্তু মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে এর তীব্রতা আরও বেশি ছিল। মধ্য-পূর্ব ও দক্ষিণ সেটা চরমে পৌঁছায়। হিটলার বলেছিলেন: 'এই কঠোর জাতীয় সংগ্রামকে কোনো সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ করা চলবে না।' এ হল ইতিহাস।
         একবিংশ শতাব্দীতে ফ্যাসিজম কখনোই হিটলার, ফ্রাঙ্কো বা মুসোলিনির মতো টোটালিটারিয়ান টেরোরিজম হবে না। এখন ডেমোক্রাসিকে ভেতর থেকে ধ্বংস করা হবে। যেমনটা বর্তমানে আমাদের ভারতে চলছে। যেভাবে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত মানুষের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে চিন্তা করতে দেওয়া হচ্ছে না! বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ভীতি আর দাসত্বে আবদ্ধ করছে রাষ্ট্রনেতারা। স্বভাবিক চলন ব্যাহত হচ্ছে। এভাবেই দেশের শক্তিক্ষয় হচ্ছে আর এমন শীর্ণ দেশে রাজত্ব করবে এই একরোখা একেবারে ডিক্টেটর রাষ্ট্রশক্তি। আমাদের কোনো কিছুই করার নেই। আমার ব্যক্তিগতভাবে একটাই কথা মনে হয়, বর্তমান সময়টায় যে-ফ্যাসিশক্তি উত্থিত হয়েছে তার বিভ্রান্তির কবলে পড়ে নিজের চিন্তাশক্তিকে হারালে চলবে না। এমন এক ডিসকোর্স আমাদের অবলম্বন করতে হবে যেখানে আমরা প্রতিবাদ তো অবশ্যই করব তবে সেটাকে হতে হবে স্বচ্ছ। এখনও মনে হয়, এই CAA আর NRC-র প্রতিবাদ যারা করছে তাদের মধ্যে সমর্থকও অনেকেই আছেন ছদ্মবেশী। এটাই সমস্যা আমাদের এই বহুজাতিক দেশের।                 
                                          

4 comments:

  1. খুব স্বচ্ছ তোমার ধারণা এবং তা কমিউনিকেট করার ক্ষমতা তোমার কলমের আছে।

    ReplyDelete
  2. ব্রাভো শতানীক

    ReplyDelete