Monday, December 23, 2019

আলোচনা- বিতান চক্রবর্তীর 'হাতকাটা' নিয়ে সঞ্জয় সাহা






“শহর কেবল খাবার পেয়ে শান্তি পায় না। তার খাদ্যের উপর ক্ষমতা চাই...”


নাম শুনে মনে হবে এ গল্প হাতকাটা দিলীপ, কানকাটা গণেশ বা ট্যাড়া কার্তিকের গল্প। ওই যেমন থাকে না পাড়া বা মহল্লায়, পেটো বাঁধতে হাত উড়ে যাওয়া তেমন আরকী! কিন্তু গল্প যত এগোতে থাকে ততই এই ধারণা থেকে মন অপসৃত হতে থাকে এবং গল্পের শেষে পাঠক পৌঁছে যা এক প্রস্তুতিহীন, অভাবিত প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনে। আর তখন উপন্যাসটি (বা উপন্যাসিকাটি) আবার ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে এবং ফিরে দেখার পর্ব শুরু হয়, তবে তা পাঠকের মনে মনে। উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকের নির্মাণপর্ব শেষ হলে পাঠকের হৃদয়জুড়ে চলে এক অবধারিত বিনির্মাণ পর্ব। আর এই বিনির্মাণ আছে বলে এই উপন্যাসেকে আমি একটি সার্থক কথায়ন মনে করি। আধুনিক কর্পোরেট জীবনের এক অলিখিত দলিল। হ্যাঁ, যে দলিল বিপিএল, যে দলিল সাব-অলটার্ন।
স্যাম্যুয়েল বেকেট্‌ আধুনিক যুগের অন্তঃসারশূন্যতা, বাণিজ্যায়ন ও মানুষের ক্রমশ একক হয়ে যাওয়ার ভয়াবহ অবস্থাকে আক্রমণ করেছিলেন তাঁর অ্যাবসার্ড নাটকের মধ্য দিয়ে— ওয়েটিং ফর গোডো। গোডো আসেনি, আসবেও না কখনো। তাই নাটকের শুরুতে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন যে অবস্থায় থাকে, নাটক শেষেও তাদের অবস্থান বদলায় না কোনো। পৃথিবীর কিছুই পালটায় না, পরিস্থিতির কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় না। ব্যক্তি-মানুষ হতাশ থেকে হতাশতর হতে থাকে। ওদের মতোই এ গল্পে কনক আর শুভ। এরাও শুরুতে যে অবস্থায় থাকে শেষেও তাই। শুভর স্টার্ক রিয়েলিটি নিয়ে কিছুটা বোধোদয় হয় ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি তখনও নিম্নমুখী, ক্রম পতনশীল। শুভ আমাদের গোটা সমাজটাকে, গোটা পাঠককুলকে স্তব্ধ করে দেয়। স্তব্ধতাই যদি শিল্প উত্তরণের মাপকাঠি হয় তবে এ শিল্প সার্থক বটে।
আধুনিকতার হাত ধরে কবে যে উত্তরাধুনিকতার শুরু হয়েছিল ক্যালেন্ডারের সেই বিশেষ দিনটি আমি জানি না। উত্তরাধুনিকতার ভালো বা খারাপ তা নিয়ে হাজারো সন্দর্ভ হয়েছে, হচ্ছে। যদিও এখন পুনরাধুনিক নিয়েও কথা হচ্ছে। কিন্তু এ-সবের ছাপ তো শুধুমাত্র শিল্প-সাহিত্য-ছবিতে পড়ছে না, পড়ছে জীবনে ও সমাজে এবং প্রাত্যহিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতেও। বরং বলা ভালো, দৈনন্দিন আটপৌরে জীবনের পরিবর্তনশীলতাই টার্মিনোলজিস্টদের বাধ্য করছে নতুন নতুন নামকরণের। সমাজ পালটায়, পালটাচ্ছেও। তাই শিল্প পালটাচ্ছে, তা সে শিল্পের ইংরেজি প্রতিশব্দ আর্ট বা ইন্ডাস্ট্রি যাইহোক। কামারপাড়া, তাঁতিপাড়া, কুমোরপাড়া, মুচিপাড়া, মেথরপট্টি নিয়ে বৃত্তিমুখী যে জনবিন্যাস তা শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এক ধরনের বাণিজ্যিক আগ্রাসন শুরু হয়। ব্যবসা হয়ে ওঠে একমুখী, কিছু নির্দিষ্ট ধনপতি, পুঁজিপতিদের। ব্যবসা যেদিন থেকে বংশানুক্রমিকতার বাইরে গেল সেদিন থেকেই পুঁজির ক্রমবৃদ্ধি শুরু হল। আর যেদিন মানুষের বদলে যন্ত্র চলে এলো সেদিন থেকে একদিকে যেমন কর্মহীনতা শুরু হল, অন্যদিকে বাড়তে থাকল মানুষের অসহায়তা একাকিত্ব আর হতাশা। গ্রামের যে ছেলেটা কৃষিকাজ জানত শহর তাকে টেনে নিলো কিন্তু কাজ দিতে পারল না। যে ছেলেটার ক্রোমোজোমে ছিল বাবার সেলাই মেশিনের ঘটাংঘট, শহরে এসে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্যাশন টেকনোলজি পড়ে এবং অবশেষে সেই অনুপাতে কোনো কাজ না পেয়ে হয়ে গেল কমপিটিটিভ এই পৃথিবীতে পরিধেয় বিক্রি করার সেলসম্যান। এই কাহিনির পাঠ নেওয়ার পর যেন অদ্ভুতভাবেই মনে পড়ে যায় সেই সনাতন ভারতীয় জীবনছন্দকে। মল্‌-সংস্কৃতির ভয়াবহতা চোখ খুলে দেয় ক্রমশ। একশোটা দোকান বন্ধ করে একশোটা ছোটো ব্যবসায়ীর পেটে লাথি মেরে গড়ে-ওঠা শপিংমল— বিশ্বায়নের নয়া ফসল, যা এখন শুধু মেট্রোপলিটন শহর নয় ছোটো ছোটো গঞ্জগুলিতেও থাবা বসাচ্ছে। তার ভয়ঙ্করতাকে এবং তাতে কাজ করা মানুষদের সীমাহীন যান্ত্রিকতাকে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন বিতান এই উপন্যাসে। পাঠক হিসেবে তো বলতে পারি না— মুভ অন, বিতান, মুভ অন...  
“ফাইট, কোনি, ফাইট।”— সে ছিল এক অদম্য স্পিরিটের গল্প। এক গঠনমূলক, আত্মজাগরূক, উৎসাহব্যঞ্জক, অনুপ্রেরণা দেওয়ার সাবাসি উচ্চারণ। উৎসাহ এখানেও আছে, অনুপ্রেরণাও হয়তো। কিন্তু এ-প্রতিযোগিতা এক কর্পোরেট পৃথিবীতে বেস্টসেলার হওয়ার লড়াই। এ-প্রতিযোগিতা আমাদের অজান্তেই এক ধনতান্ত্রিক পৃথিবীতে “আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান”-এর প্রতিযোগিতা। এ-প্রতিযোগিতায় রক্তের লোহিত কণিকা ফেলে শুধু অর্থের পেছনে ছুটে মালিকের মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। এ-তো গেল সেলসম্যান কনকের রানিং ইভেন্ট। আর শুভর ক্ষেত্রে একটু দাঁড়াবার জায়গা খোঁজার প্রতিযোগিতা। দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে প্রসাধনী বিক্রি এবং বিকেলে লটারির টিকিট। শুভ যেন সেই বাতিওয়ালা যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার ঠিকানা। শুভ দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে। নিজের কাছে নিজেই না খেয়ে থাকার পরীক্ষা দেয় যেন। এ-সব জায়গায় উপন্যাস যেন হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই ভাস্কো-দা-গামার খাদ্য আবিষ্কার। কী সীমাহীন দারিদ্র্যের ছবি আঁকেন বিতান মাত্র কয়েকটি শব্দে তা সত্যিই অশ্রুসজল করে, এমনকী এই কর্পোরেট যুগেও। খাদ্য শুধু ক্ষুধা নিবারণের উপকরণ নয়, ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা মাধ্যম, আর খাদ্য উৎপাদন হলেও তার নিয়ন্ত্রণ থাকে শহরের মুষ্টিমেয় কয়েকজনেরই ওপর। কাহিনিকার বিতান এই রাজনীতি, এই বৈষম্য ধরেছেন এই উপন্যাসে। বিনিময় প্রথার যুগ যে শেষ হয়েছে তা এখনো বুঝতে পারেন না অজপাড়াগাঁয়ের শঙ্খ-ফুঁ-এ সন্ধ্যা-নামানো মাঝবয়সি মায়েরা। “তবে কেন মা এখনো কেবল বস্তু বিনিময় প্রথায় বিশ্বাস করে। মা কেন এখনো শেখেনি শহর কেবল খাবার পেয়ে শান্তি পায় না। তার খাদ্যের উপর ক্ষমতা চাই। এই ক্ষমতা আদায়ের যুদ্ধে এই সামান্য ক-টা পুঁইডগা মাড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে কয়েক মুহূর্তও লাগবে না।” অনাহারে থাকার কায়দা রপ্ত করাও যে এক শিল্প, তা শুভর মতো পাঠকও বুঝতে পারেন। কাফকার “আ হাঙ্গার আর্টিস্ট” গল্পটির কথা মনে পড়তে থাকে।
এ-তো গেল আবহমানের গ্রাম-শহর, সরল-জটিল, গ্রামীণ-নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্ব। কিন্তু হাল আমলের কলকাতাও তো পালটে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য ত্বরণে। প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক ইঙ্গিতও আছে তার। বিশেষ করে পাঁচ-সাত বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গেও যে ইউপি কালচার ঢোকানোর এবং তাকে জনপ্রিয় করার একটা চেষ্টা চলছে রাজনৈতিকভাবে এবং আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সেই জীবাণু সংক্রমণ করে চলেছি আমরাই একে অপরকে, তাও খুব স্পষ্ট করে বলা আছে। বাংলা সংস্কৃতি ও বাঙালিত্ব হারানোর অশনিসংকেত দেখতে পায় কনক। শুভকে বলে, “বুঝলি ভাই, দশ বছর পর লোকে কলকাতাকে আর বাঙালিদের শহর বলবে না। কলকাতা বিহার-ইউপি-তে ঢুকে যাবে।”
কবিতার সাথে কথা সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো পার্থক্য— গদ্য যুক্তি পরম্পরা দাবি করে, সহজ প্রবাহ দাবি করে। আর তা শুধু কাট-কাট তত্ত্ব বা ঘটনার বিবরণ দিয়ে সম্ভব নয়, তার জন্য দরকার রসময় বাক্য গঠন, তবে তা যেন ভাঁড়ামো না হয়ে যায়। কথাসাহিত্যিকের রসবোধই উপন্যাসকে পড়িয়ে নিয়ে যায়, তা সে ঋষি গদ্যকার বঙ্কিমই হোক আর আমাদের হাল আমলের সাদিক বা অনির্বাণ। বিতানের এই উপন্যাসেও বাক্য ও তার গঠনপ্রণালী সরস ও সতেজ। উপচে পড়া ট্রেনের পাদানিতে পায়ের পাতাটা তুলে দিতে পারলেই “তখন আর পাশের যাত্রীর টপটপ করে পড়তে থাকা ঘামকে ঘাম মনে হয় না, যেন বৃষ্টির দানা।” আবার যুবক বয়সের স্বাভাবিক প্রেম শেষ হয়ে গেলে তার অবস্থা বর্ণনা করতেও ঔপন্যাসিক কী সুন্দর করেই না বলেন, “জগজিৎ সিং-এর গজলের স্টকও শেষ হয়ে আসে একদিন।” মেস-বাড়ির কথা বলতে গিয়ে অমোঘ ও অনিবার্য তিনটি শব্দ প্রয়োগ করেন— “সস্তায় পুষ্টিকর মেস”। পিংক ও বেজ কালারের তফাৎ, দীর্ঘদিন জাঙ্গিয়া না ধোওয়া তো শুধু হাস্যরস নয়, এক করুণ চিত্রও বটে। আবার যেদিন দশ হাজার টাকার লটারি লাগে সেদিন দোকান সাজানো— “প্রতিদিনের ঠাকুরের সরু মালার পরিবর্তে একটু মোটা মালা দেওয়া হয়, সাথে নকুলদানার বদলে দশ টাকার গুজিয়া।” “মাত্র” শব্দটা যে কত আপেক্ষিক তাও বুঝতে পারি আমরা শুভর চারশো টাকায় যা ক্ষতিপূরণ দিতে ওকে আট দিন রাতে না খেয়ে থাকতে হবে এই আপ্তবাক্যটি এর মধ্যে। আবার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড তার যে-কোনো কর্মীকেই “কাজ শেষ হলেই এক লাথ মারবে, স্টক থেকে স্টক আউট করে ছেড়ে দেবে।” এ-সব লাইনগুলো শুধু আর রসময় থাকে না, হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক, শ্লেষাত্মক ও একই সঙ্গে হৃদয় বিদারকও। হিউমার এবং প্যাথোজ হাত ধরাধরি করে আছে এখানে। এবং হিউমার প্যাথোজকে সুসংবদ্ধ ও শক্তিশালীও করে।
আঙ্গিকের দিক থেকে দেখলে “হাতকাটা”-কে প্রথমে গল্প বা সর্বোচ্চ বড়ো গল্প মনে হতে পারে। কেননা চরিত্রের সংখ্যা বেশি নয়, প্লটও দু-একটা ঘটনাতেই আবর্তিত। মাত্র দুটো চরিত্র প্রায় সমান্তরালভাবে এগোতে থাকে। একজন আপাতভাবে জীবন সংগ্রামে কিছুটা সফল মাত্র। ওপন্যাসিকের ভাষায় কিছুটা মুভ অন করেছে। দ্বিতীয়জন অর্থাৎ শুভ, তার গায়ে এখনো গ্রামের পুঁইশাকের গন্ধ, এখনো অন্তত মায়াটুকু আছে এমনকী যে ওর চারশো টাকার লটারির টিকিট হাপিস করে দেয় তার প্রতিও। শুভ আস্তে আস্তে এ-শহরের কর্পোরেট লাইফের চেহারাটা বুঝতে পারে। কাহিনি তাই এক অর্থে শুভর শিক্ষা আর তার শিক্ষা পদ্ধতি। যখন শুভ তার পাসপোর্ট-সাইজ ছবি যা সে অনেক আশা করে কনককে লাগিয়ে দেয় মাঝে মাঝেই ওর সিভিতে, সেটা আবিষ্কার করে রাস্তায়, সেখানেই গল্পের ক্লাইম্যাক্স হতে পারত, কিন্তু তাতে গল্প হত উপন্যাস হত না। আর যে পেরিফেরি, যে মিলিউ (বাতাবরণ) বা যে প্রেক্ষিত তা সামাজিক-রাজনৈতিক জাতীয় এবং বৈশ্বিক সব অর্থেই লেখক বেছে নিয়েছেন বা উল্লেখ করেছেন তার কিছু সূক্ষ্ম তুলির টানে তাতে লেখাটাকে আর গল্পের আঁজলায় ধরা যাচ্ছিল না। তাই প্রথমে একে হালকা গল্প মনে হতে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কাহিনিটিকে আস্ত একটি উপন্যাসই মনে হয়।
কথাসাহিত্য সময়কে ধরে রাখে পুঙ্খানুপুঙ্খ। যে ঘুলিয়ে দেওয়া, গুলিয়ে দেওয়া সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি তারই উল্লেখ প্রতিটি পাতায় পাতায়। “আজকের মেট্রোপলিটন দুনিয়ায় ফ্যাশন ব্যবসা যাকে বলে আগুন আগুন।” সত্যি-ই তো তাই। শুধু নিজের বাইরেটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, আমাদের ভেতরে তো কবেই পৌঁছে গেছে। সেটাকে আড়াল করার জন্যই কি এত আয়োজন? না, লেখক বলেননি, কিন্তু সচেতন পাঠকের মনে হবেই এ-কথা। বা “শালা পাকিস্তান হারলেও এত আনন্দ হয় না, আজ যা আনন্দ হচ্ছে কনকের।” চারিদিকে যেমন মেকি দেশপ্রেমের (সিউডো পেট্রিয়টিজম) বিজ্ঞাপন চলছে তাতে এরকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু লেখকের খোঁচাটা বিদ্ধ করে সরাসরি; লেখকের তো ভারত-পাকিস্তান নেই। লেখা বৈশ্বিক, লেখক আন্তর্জাতিক। এই বেচাকেনার পৃথিবীতে ওই যে সুমন লিখেছেন, “কেউ বেচে তার মেহনত হাতের পেশী / কেউ বেচে চুলের বাহার এলোকেশী...” কেউ একজন টার্গেট ঠিক করে দিয়েছে, আমরা সবাই সেই টার্গেটের পেছনে দৌড়োচ্ছি। এক টার্গেট-ওরিয়েন্টেড ব্যাপ্ত পৃথিবীর ছবি চারদিকে। আর না পৌঁছোতে পারলেই হতাশা। প্রতিটি মানুষের একা থেকে একক হয়ে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস সশব্দ হয়ে ওঠে এখানে। হ্যাঁ, যাদের চাকরি আছে, কাজ আছে তাদের টার্গেট। যাদের কাজ-ই নেই তাদের টার্গেট কী হবে! প্রতিদিন রিসেশন, প্রতিদিন গোল্ডেন হ্যান্ডশেক, জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের তার নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব অস্বীকার, তার কী হবে! না, ঔপন্যাসিকের দায় নেই উত্তর খোঁজার, উত্তর খুঁজব আমরা, যারা শুভর হাত কাটার ব্যথায় নীল হয়ে যাই। এবং নিজেকেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে শুভ তো এতটুকু ভুল করেনি। যদি হাতের প্রয়োজনে ফুরিয়ে যায় হাত তো বাহুল্যমাত্র। ক্রমবর্ধমান যন্ত্র-সভ্যতার আগ্রাসনে হাত কি একটা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ হতে চলেছে? যদি সে হাত বিশেষ করে কোনো প্রান্তিক মানুষের হয়, যদি সে হাতের পেছনে আরও দশটা হাত না থাকে, যদি সে হাত “সিলেক্ট” না হয় মুষ্টিমেয় প্রয়োজনীয় হাতের তালিকায়...
বিতানের “হাতকাটা” তাই এক অর্থে বিরাট থাপ্পড় এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড-এর প্রতি। এক বিরাট প্রশ্ন ভবিষ্যতের জন্য। যদি এমন একদিন সত্যিই আসে, কোনো কর্মসংস্থান না থাকে পৃথিবীতে নিম্নমধ্যবিত্তের করবার মতো, পাওয়ার মতো, তবে হাত তো আক্ষরিক অর্থেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। হয়তো একদিন লেজের মত খসেও পড়তে পারে! তাই উপন্যাস পাঠ শেষ হয়ে গেলেও, ডান হাত কেটে ফেলবার পরেও শুভর কথাগুলি কানে বাজতেই থাকে— “জানিস কনক, কিছুদিন পর এই দেশে আর কোনো মানুষের ডান হাত থাকবে না। আর পড়িসনি জীবন বিজ্ঞানে, অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমাদের সবারও তাই হবে। আর আমি সেই নতুন হাতকাটা প্রজাতির প্রথম প্রতিনিধি।”
প্রসঙ্গত, “শিল্পান্তর” সিনেমাটির কথা মনে পড়তে থাকে যেখানে কাঁচা মুরগি রোজ খেতে খেতে অভ্যস্ত মানুষটি একদিন নিজের হাত নিজেই কামড়ে কামড়ে খেয়ে নিচ্ছিল। এই ভয়াবহ ইঙ্গিত ও প্রতীকধর্মী জাদুবাস্তবতায় উপন্যাসটি শেষ হয়। উল্লেখ্য এর অসাধারণ প্রচ্ছদটি কিন্তু সেই জগন্নাথের, যে দেবতা এবং ঠুঁটো। শুভ আসলে এক নায়ক, যার নামার্থ ‘ভালো’, সে-ই অমৃতের সন্তান কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী, কর্মসন্ধানী অথচ কর্মহীন। এ-উপন্যাস তাই আজকের জগন্নাথদের ঠুঁটো হওয়ার গল্প। আর বিতান সেই কারিগর যে মাঝপথে মূর্তি বানানো ফেলে চলে যায়, আর পাঠকেরা বাকিটুকু ভেবে আতঙ্কিত হয়। হতেই থাকে, হতেই থাকে...

গ্রন্থসূত্র:
হাতকাটা / বিতান চক্রবর্তী / হার্ডবাউন্ড / অগাস্ট ২০১৯ / পৃষ্ঠা ৮৮ / শাম্ভবী / ১৭৫ টাকা 


No comments:

Post a Comment