পরিযায়ী
"দেইখ্যা পা ফ্যালাস
হাসি…. আরেকটু... আরেকটু... সামনে গর্ত আছে..." বাঁধে
দাঁড়িয়ে আজমল হাসিরামকে চিৎকার করে বলে। হাসিরাম মালো ওঁর সতেরো বছরের মেয়ে বুলি
কোলে নিয়ে, লুঙ্গিটা লেংটির মত গিঁট মেরে জল পেরোচ্ছে।
মিশকালো সুঠাম তেতাল্লিশের হাসিরাম তাঁর স্ত্রী সরস্বতীকে বলে,"সাবধানে আইস, মিঠুনের হাত ছাইড় না"। কাল
সারারাত বৃষ্টির পর সকালে টাকিমারীর চরের চারিদিকে শুধু নদীর ঘোলা জলের স্রোত।
হাসিরাম বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি থেকে ক্যানেলের বাঁধের দিকে যাচ্ছে। সরোর মাথায় একটা
কাপড়ে বাঁধা পুটলি, এক হাতে ওঁর বারো বছরের ছেলে মিঠুনের
হাতটা শক্ত করে ধরা। আজমল বাঁধে ওঠার রাস্তার থেকে খানিকটা নেমে এসেছে ওদের হাত
ধরে সাহায্য করতে আর চিৎকার করছে, "দেইখ্যা পা ফ্যালা...
পানি আর গর্ত মিশে এক এইখানে..."।
"পানি থামার কোনো যো
নাই, আরো হরহরায় নামতেসে" বৃদ্ধ হাফিজ মোল্লা ক্যানেলের
উপর সরকারি ত্রিপলের টেন্টে বসে বলেন। "নদী আজকেও ঝাপসা দেখা যায় চাচা"
সত্য হাফিজকে বলে। "কেনেল থেকে যে আর কত পানি ছাড়ার বাকি আল্লাই জানে" হাফিজ বলেন।
শ্রাবণ মাসে পাহাড় ও সমতল ডুয়ার্সে টানা বৃষ্টির জন্য তিস্তা ব্যারেজের স্লুইস গেট
খুলে দিয়েছে ব্যারেজ ডিভিশন। গতকাল রাত থেকেই নদীর ঘোলা জল টাকিমারীর চর
মিলনপল্লীতে ঢুকে মালোপাড়া পূর্বপাড়া ভালোবাসার মোড় ভাসিয়ে দিয়েছে।
"শুনছ, বুলির জন্য একটু জল আনি দিবা", সরো হাসিরামকে
বলে। হাসিরাম ক্যানেলের বাঁধের ওপর রাস্তায় পাতা সরকারি টেন্টের একটা দিক পরিষ্কার
করছিল, একটু বসার জায়গা তৈরি করতে, চারিদিক
জলে ভেজা। বুলির ঠোঁট গলা শুকিয়ে আসছে তেষ্টায়, শুধু হাত
দিয়ে ইশারা করে মায়ের কাছে জল চাইছে বারবার। বুলি কথা বলতে পারেনা, জন্মের থেকেই শরীরের বাড়বাড়ন্ত হলেও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি।
সদরে অনেকবার ডাক্তার দেখিয়েও কিছু লাভ হয়নি। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন তো
হাঁটাচলাতেও অসুবিধা হয়। সারাদিন বসে বসে দোলে বুলি। বুলি মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার
ইশারায় অস্ফুট ভাবে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে। হাসিরাম ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে
একটা পুরানো কোল্ডড্রিংক এর বোতল জোগাড় করে, বাঁধের ওপর
পঞ্চায়েতের রেখে যাওয়া লোহার জলের ট্যাংকটার দিকে এগিয়ে যায় বোতলটা হাতে করে।
"হালার এই বিষ্টিতেও জল নিতে এত মানষের লাইন!" মনে মনে বলে হাসিরাম
মালো।
নৌকার ভাড়া ধরা নিয়ে আজমল মিঞার সঙ্গে
হাসিরাম মালোর দা কুড়াল সম্পর্ক। শীতের সময় যখন টুরিস্টরা তিস্তায় নৌকা চড়তে আসে, তখন ভাড়া ধরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে শুরু হয় ঝামেলা। মাঝে মাঝেই ঝামেলার জল
পঞ্চায়েত অবধি গড়ায়। আজমল হাসিরামের বাল্যবন্ধু। তাঁরা ওপার থেকে একসঙ্গে এ দেশে
এসেছে, টাকিমারী চরে পাশাপাশি বাড়ি ওঁদের। দুটো বাড়ির মাঝে
শুধু সারিসারি সুপুরী গাছ, সেগুলোই বাড়ির সীমানার বেড়া।
সেইখানে দুটো সুপুরী গাছের মধ্যে পাটের রশি দিয়ে একটা দোলনা বানিয়ে দিয়েছে আজমল।
হাসিরামের ছেলে মিঠুন আর আজমলের মেয়ে আসমা চোটের বস্তা পাতা দোলনায় খেলা করে।
বুলিকে সরো চট পেতে উঠোনে বসিয়ে রাখে। বুলি ওদের দোলনা চড়া দেখে আর বসে বসেই দোলে।
মাছ ধরা আর তিস্তা ব্যারেজে পরিযায়ী পাখি দেখতে আসা টুরিস্টদের ডিঙি নৌকায় প্রমোদ
ভ্রমণ করানোই মালোপাড়ার আজমল হাসিরাম পাতু নিরঞ্জনদের জীবিকা।
"খিচুড়ি নিয়া আসো
হাসিদা, এরপর গেলে আর পাবা না, শ্যাষ
হয়ে যাবে" পাতু হাসিরামকে বলে। সরস্বতী পোটলা থেকে রিলিফের শুকনো চিঁড়ে জলে
ভিজিয়ে মিঠুন আর বুলির সামনে একটা কানা উঁচু স্টিলের থালায় দেয়। বুলি ঠিক করে মুখে দিতে
পারে না, চারিদিকে ছড়িয়ে যায় চিঁড়ে গুলো। "জলদি কর তোরা,
এই থালিটাও নিয়া যাব, যতটা খিচুড়ি আনা
যায়..."। এদিকে ক্যানেল দিয়ে ঘোলা জলের স্রোতে ভেসে আসা জলহওয়ায় শ্রাবণ মাসের
বিকেলে বাচ্চা গুলোর গায়ে কাঁটা দেয়।
"যেটুকু হাল দিসিলাম
সব ভাইসা গেল রে হাসি!", খিচুড়ি নেওয়ার লাইনে থালা নিয়ে
দাঁড়িয়ে বলে সত্য। সত্যের বাড়ি টাকিমারীর চরের পূর্বপাড়ায়। সত্য নৌকা চালানোর থেকে
হালকৃষি বেশি করে। সত্যদের পাড়ার আগে পরে মালোপাড়া। সত্য থাকে পূর্ব পাড়ায়।
"আমার তো হালার সব বিডিও অফিসের কাগজ ভাসি গেল", হাসিরাম
সত্যকে বলে। তিস্তার পরের মিলনপল্লী টাকিমারী চরের এতকাল পরে থাকা অনাবাদী ঊষর
জমিতে নিজেদের খাওয়ার মত ধান সবজি করত সত্যরা। যদিও লোকে বলে এখানকার সবজি এখন
জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির বাজারেও যায়। শহরের শপিং মলেও নাকি এখানকার ফলানো সবজি বিক্রি
হয়, সত্যরা শুনতে পায়। কিন্তু ফসলের দাম পায় না। ফরেরাই সব
খেয়ে নেয়।
সদরের ভদ্রলোকেরা বলেন এটা "বাংলাদেশ থেকে আসা চরুয়াদের পাড়া"।
হাফিজ মোল্লা টেন্টে বসে বলছিলেন,"
আমরা যখন টাকিমারীর চরে আসি, এইখানে মানুষ
আইতে ডরাইতো! চারপাশ ধূধূ ফাঁকা। আগে আমাদের ভোট ছিল না, কোনো
কার্ড ছিল না, পরিচয়ও ছিল না, কোনো
দ্যাশ ছিল না, কিন্তু আমরা এখন এই টাকিমারী চরের বাসিন্দা,
এই দ্যাশের নাগরিক, আমার ভোটের দাম আছে।" নিরঞ্জন হাফিজের কথা শুনে খ্যাকারী দিয়ে বলে,"চাচা বাজে কথা কইয়ো না। ভোট থাইক্যাই বা কি হইল। এই দ্যাশটা কি নিজের হইল?
কোনটা তোমার দ্যাশ?" আজমল বলে,"একবার লাথ মাইরা ওই দ্যাশ থেইক্যা এই দ্যাশে আসি, এখন
আবার লাথ খাওয়ার সময় আইছে, ওই দ্যাশে যাইতে হবে নাকি কাগজ না
থাকলে, কি নাকি আইন আইসে!" হাফিজ আকাশের দিকে তাকিয়ে
বলেন, "লাগে তো মাত্তর সাড়ে তিন হাত জামিন, সেটা কোনো দ্যাশে পাবো না রে…!" এই পাড়ায় সবাই
মালো। মাছ ধরাই এই পাড়ার সকলের রুজি রোজগার।
কার্তিক অঘ্রান মাস থেকে বাইরে থেকে
ট্যুরিস্ট আসা শুরু হওয়া, পাখিরাও আসে বাইরের দেশ থেকে। আশ্বিন মাসে বর্ষার ধূসর মেঘ চলে গেলে তিস্তার
নীল জলে বরফ ঢাকা পাহাড়ের ছায়া পড়ে। শরতের তিস্তায় ব্যারেজের শান্ত জলে যে বরফ
চূড়ায় ছায়া পড়ে। সেই জলছবিকে লগির টানে ভেঙে ভেঙে চলে হাসিরাম মালো নিরঞ্জন মালো
আজমল মহম্মদের ডিঙি নৌকো। বর্ষার পর নীল আকাশে সাদা ছোট ছোট মেঘ ভেসে আসলে চখা
চখির দল লাদাখ তিব্বত পেরিয়ে তিস্তার ব্যারেজে আসে প্রতি বছর। ঠিক যেমন প্রতি বছর
কোননা কোন ভোট আসে। গত লোকসভার ভোটের আগে মালো পাড়ার অনেকেই পাট্টা পেয়েছে চরের
জমির। ভোট আসলে এই অঞ্চলে নেতাদের আসা যাওয়া বেড়ে যায়। এবার হাসিরাম মন্টুদের
পাড়ার লোক রফিকুল দুই নম্বর অঞ্চলের পঞ্চায়েতের উপপ্রধান।
উপপ্রধান রফিকুলের নিজের ঘর ঘোলা জলের
তলায়। ওঁর বিবি বাচ্চা এই বাঁধের একটা ত্রিপলের টেন্টেই আছে। রফিকুল খিচুড়ি বিলির
তদারকি করছে। খিচুড়ি আর ঘাঁটি তরকারি নিয়ে টেন্টে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় হাসিরামের।
কিছুটা দূরে বৃষ্টিতে ঝাপসা দেখায় তিস্তাকে, নদীর পাশেই বৈকুণ্ঠপুর ডিভিশনের আপালচাঁদ তারঘেরার জঙ্গল। এক
নাগাড়ে ঝিঝি পোকা, ঘন্টাপোকা ডেকেই যাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দেরই
মত এর কোনো বিরাম নেই। হপ্তাখানেক আগেও হাতি এসে ধান খেয়ে গেছিল হাসিরামের জমির।
চরের জমিতে সকলের মত হাসিরামও সামান্য চাষবাস করে,বছরের
চাল সব্জিটা খেত থেকেই হয়ে যায়। কিছুটা হালকৃষি, কিছুটা মাছ
ধরা, 'সিজিন টাইমে' নৌকায় টুরিস্ট
পার্টিকে ঘোরানো। সব মিলিয়ে জোড়াতালি সংসার হাসিরামের।
হাসিরামদের ভাষায় জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ি
থেকে গজলডোবা ব্যারেজে ঘুরতে আসা লোকেরা "লোকাল"। শহর থেকে পাখি দেখতে
আসা অনিন্দ্য শুভাশিসরা "লোকাল টুরিস্ট"। হাসিরাম আজমলদের সঙ্গে
জলপাইগুড়ির অনিন্দ্য শুভাশিসদের পরিচয় বছর অনেক বছরের। পরিচয় পর্বে অনিন্দ্য জানতে
চেয়েছিলেন, "তোমাদের দেশের
বাড়ি কোথায়?" "টাঙাইলের যমুনার পারে আমাদের
দ্যাশের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জ। আমি আজমল পাতু নিরঞ্জন সত্য সব একই গ্রামে
থাকতাম।" তিস্তার ভাটিতে কালো পেশীবহুল হাতে লগি ঠেলতে ঠেলতে উত্তর দেয়
হাসিরাম। "সিজিন টাইমে" মাছ না ধরে ডিঙি নৌকায় করে শহরের বাবুদের পাখির
ছবি তোলাতে নিয়ে যায় উজানের দিকে। সেই কাজ করতে করতে হাসিরাম পাখির নির্ভুল ইংরেজি
নামগুলো শিখে গেলেও বাংলাদেশের উচ্চারণ আর এই অঞ্চলের উচ্চারণ মিলে মিশে এক হয়ে যায়
হাসিরামদের মুখের ভাষায়, টাকিমারী মিলনপল্লী অঞ্চলে। পাহাড়
থেকে এসে তিস্তা নদীর জল যেমন মিশে যায় বাংলাদেশে যমুনায়। জলকে যেমন কোন নদীর জল
বলে আলাদা করা যায়না, তেমনি হাসিরাম আজমল মুখের ভাষাকেও
কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করা যায় না, দুই পারের ভাষা মিলে
মিশে এক হয়ে যায়। হাসিরাম বলে," আমার চোদ্দ বছর বয়সে
যখন যমুনায় বান আইল, সেই বছর বাবা এইখানে চলে আসে। আমার বাপ
ঠাকুরদা সক্কলে যমুনায় মাছ ধইরেই জীবন কাটাইসে"। মাছ ধরার চেয়ে
"সিজিনে" যদিও নৌকা চালানোতে আয় অনেক বেশি। "আপের দিকে"
ট্যুরিস্ট নিয়ে গেলে মোটা টাকার ধান্দা হয়। অনিন্দ্য ওঁর দামি লেন্স দিয়ে পাখির
দিকে তাক করে জিজ্ঞেস করেন, "এখন মাছ ধরো না কেন?"
হাসিরাম বলে,"শুনছি নদীর আপের দিকে
পাহাড়ে কোথায় একটা যেন এই রকম একখান ব্যারেজ হইসে, ওইখান
থেকে দিনে একবার ঘোলা জল ছাড়ে। ঘোলা জলে মাছের ডিম বাঁচে না দাদা। তাই তিস্তায় মাছ
আগের মত নাই, কইমা গেসে, এদ্দিন তো মাছ
মাইরা সংসার চালাইতাম… প্রতিদিন নতুন নতুন বাঁধ গুলা মাছ
গুলারে শ্যাষ করি দিলো। মাছ ধইরা আর ধান্দা চলে না, ঘরে
পোলাপান আছে!"
"ওঠ খাওয়ার আনছি,
খায়ে নে… হাসিরাম বুলিকে বলে"। মাথায়
ঘোমটা টেনে সর থালার থেকে মেয়েকে খাওয়ায়। মিঠুনকে অন্য একটা থালায় খেতে দেয়। বুলির
মুখ থেকে খাওয়ার গড়িয়ে পড়ে, সর ভেজা হাত দিয়ে বুলির মুখ
মুছিয়ে দেয়। বুলির গা টা বেশ গরম। "শুকনা জ্বালানি গুলা নদী সব ভাসায় নিয়া
গেল" সার হাসিরামকে বলে। আষাঢ় মাসে পাহাড়ের বৃষ্টি হলে মাঝে মাঝে মারা কাঠ
ভেসে আসে তিস্তায়। হাসিরাম আজমল সকলেই সেই কাঠ ধরার জন্য নৌকা নিয়ে নদীতে যায়।
সেগুলো শুকিয়ে জ্বালানি কাঠ করে ঘরে তুলতে পারলে অনেকদিনের জন্য জ্বালানির খরচ
নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এবারও অনেক কাঠ তুলেছিল, সেগুলোকে
কেটে "সাইজ" করে ঘরের বাইরে পোয়ালের গাঁদার পাশে সাজিয়ে রেখেছিল
হাসিরাম। "এই জলে কাঠ তো কাঠ, বিডিও অফিসের থেইক্যা
দেওয়ায় কাগজ, পাট্টার কাগজ, রেশন তোলার
কার্ড সব ভাসি গেল, ঘর খান পাই কিনা দ্যাখো, তুমি হালার কাঠের চিন্তা লাগাইস…" হাসিরাম
সরোকে বলে। সরো মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিরামকে বলে,"বুলির
শরীলটা ভালো নাই গো!"
তিস্তার ঠিক পাশেই বিরাট ঝিলের মাঝে
মাঝেই হোগলার জঙ্গল। এই ঝিল আর নদীই হাসিরাম আজমলদের রুটিরুজি। হাসিরাম অনিন্দ্যকে
বলে "লোকে বলে চখা চখি জোছনা পান কইরা বাঁচে।" মিতভাষী অনিন্দ্য মুচকি
হাসে। তিস্তায় নৌকার লগি ঠেলতে ঠেলতে, হাসিরাম অনিন্দ্যকে বলতে থাকে, " কি
যে হইল, তখন তো আমার বয়েস আমার ছেলের মতই হব, বুঝলেন না দাদা, সিরাজগঞ্জে যমুনায় জল বাড়ার পর আমি
আজমল নিরঞ্জন পাতু সবাই একটা পেরাইমারী ইস্কুলে উঠছিলম, পেত্তেকবার
যেমন উঠতাম। জলে ভাসি গেল আমাদের বাড়ি ঘর। নদী মুখ দিল পাল্টায় । সকলে সলা কইরে
চলে আইলাম এই দ্যাশে, এই টাকিমারীর চরে। বাবা কইসিল ওই
দ্যাশে আর নাকি থাকা যাইব না, আমাদের থাকার অবস্থা নাই! কেন
কে জানে,।" "কি ভাবে আসলে?" অনিন্দ্য হাসিরামকে জিজ্ঞেস করে। "কিছুটা বাসে,
কিছুটা হাইটে চ্যাংড়াবান্দা হয়ে তিস্তার চর ধইরা আইছিলাম, দালালে বর্ডার পার করে দিসিল, মনে আছে শুধু যেটুকু
টাকা ছিল দালাল আর পুলিশ মিলে নিয়া নেয়।" অনিন্দ্য বলেন একদিকে তখন লোক থাকত
না? "যখন আসি এই দিকে সব ফাঁকা, মাত্র
কয়েক ঘর লোক থাকত, বাকিটা জঙ্গল! রাতে হাতির ডাকে ঘুম ভাঙি
যেত, ওই দেশে বাপের জম্মেও হাতি দেখি নাই।" বলে
হাসিরাম।" আমরা ওইখান থেইকা আইসা শুধু মাছ ধরতাম না, এই
চরের মাটিতে ধান সবজিও করতাম! তার আগে এইখানে চাষাবাদী হইত না!" নৌকা ঠেলতে
ঠেলতে হাঁফিয়ে ওঠে হাসিরাম। একটু এগোলে স্রোতের জল পেলে নৌকায় বসে দাঁড় ধরে
হাসিরাম, ডিঙি নৌকো স্রোতে আপনিই এগিয়ে যায়। বৈকুণ্ঠপুর
জঙ্গলের ওই পরে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। এই পাহাড় পেরিয়েই পাখির দল আসে
গজলডোবায়।
বৃষ্টি থামলেও জল এক ফোঁটাও কমেনি।
হাসিরাম আজমল সত্য পাতু নিরঞ্জনরা সন্ধের সময় ব্যারেজের দিকে গিয়েছিল। ডিঙি
নৌকোগুলো জলের ধাক্কায় দুলছে আর বাঁধের বোল্ডারে ধাক্কা মারছে নৌকার সূচলো মাথাটা।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়িতে টান দিতে দিতে হাসিরাম বলে,"পাহাড়ে বৃষ্টি না কমলে জল কমার লক্ষণ
নাই, ব্যারেজ আর কত জল ছাড়বে"। হাসিরামের থেকে বিড়িটা
নিয়ে আজমল বলে," হালার নেতা গুলা কবে যে আমাদের এই দেশ
ছাড়া করবে, আমার সব পেপার তো খায়ে নিল তিস্তার জল, ঘরটাও গেল।" পাতু বলে,"ভোটের সময় যেই
প্যাপারে ভোট হয় সেইটা নাকি হব না, কয় অচল! পাট্টার কাগজ হবে
না! কি লাগে এদের?"
"ভোট লাগে
এদের!" হাসিরাম চোয়াল শক্ত করে বলে।
"তোদের আর কি চিন্তা,
চিন্তা তো আমাদের, কি যে আইন আনে!" আজমল
বলে।
"বান যখন আসে তোর ঘর
ভাঙলে আমার ঘর কি রক্ষা পায় রে আজমল, দেখিস না!"
হাসিরাম বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দেয়।
"কিন্তু আমাদের কি
হবে?" আজমল বলে
"যা হওয়ার এক সাইথে
হব, আজ হালার রফিকের কি অবস্থা দ্যাখ! ও তো উপপ্রধান। ওর
মনেও ধুকপুকানি!" হাসিরাম বলে।
"প্যাপার প্যাপরা আর
প্যাপার চায় শুধু, মানুষ গুলার কোনো দাম নাই" আজমল বলে।
"আসলে গরীব মানসিরই
কোনো দাম নাইরে। এই ঘাট থেকে ওই ঘাট নৌকা গুলার মত ঠোক্কর খায়ে বেড়াচ্ছি!"
হাসিরাম বলে।
বৃষ্টির জলে শুধুই ঝাপসা চারপাশ, দূরে কিছুই দেখা যায় না। ঘোলা জলের ঘূর্ণির
মধ্যে মরা কাঠের গুঁড়ি পাক খেতে খেতে চলে যায় ওই পারে।
সরো বুলিকে জড়িয়ে রাখলেও ওর কাঁপুনি কমছে
না, কেঁপেই যাচ্ছে জ্বরে।
বুলির মুখ দিয়ে শুধু গোঙানি। বুলি কথা বলতে না পারলেও সরো ওর সব কথা
বোঝে। " একটা চাদর করো কাছে পাও কি না দেখবা" হাসিরামকে বলে সরো। রফিকের
বিবি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, "দাঁড়া,
আমি দেখি গিয়া শুকনা চাদর পাই কি না!"। রাতে কারোই তেমন ঘুম
ধরেনি চোখে। একবার বৃষ্টি হয়, একবার থামে। দূরে টাকিমারীর
চরে শুধু কালো কালো গাছের মাথা গুলো দেখা যায়। জলের নীচে বাড়ি ঘর হাল দেওয়া ধান
সব্জি। হাসিরাম সরোকে বলে, "ভগবানের কোনো বিচার নাই সরো,
যেই দ্যাশে যাই শুধু ভাইসেই বেড়াই নৌকার মত, কিনার
আর পাইনা।
সকালের দিকে কিছুটা জল নামলেও বুলির জ্বর
নামেনি। কয়েকটা কলা গাছকে জুড়ে কয়েকটি ভেলা বানিয়েছে আজমল পাতু নিরঞ্জনরা। বাঁধ
থেকে নেমে ভেলা নিয়ে মালো পড়ার দিকে লগি ঠেলে রওনা হয় তারা। এদিকে সরো পুটলিটা
গিঁট বেঁধে এক দৃষ্টিতে মেয়ের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকটা জমির খাজনার
রশিদ ছাড়া পুটলিতে কোনো সরকারি কাগজই আনতে পারেনি সরো। প্রতি বছর ভোটের আগে বলে
কয়ে টাকা "খাওয়ায়" কি ভাবে যে একটা একটা করে কাগজ জোগাড় করেছে হাসিরামই
জানে। মিঠুন মাকে বলে,"মা কখন যাব বাড়িতে আমরা?"। মিঠুন
সব বুঝতে পারলেও মন টেকে না ক্যাম্পে থাকতে। আগের বার বন্যার পর টেন্ট থেকে ফিরে
গেলে মিঠুনের খেলার সঙ্গী আফতারের খুব পেটের অসুখ হয়। তিনদিন সদর হাসপাতলে থাকার পর তেরো বছরের আফতারের মরদেহ
বাড়িতে ফিরেছিল। খালিপায়ে হাফপ্যান্ট পড়া মিঠুন দিদির দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে
থাকে।
মিঠুনের খেলার সঙ্গী আফতারের মৃত্যু
অনেকটা একা করে দেয় মিঠুনকে। নদীর মত একা।
পলি পড়ে যাওয়া তুলসী তলায় সরো প্রদীপ জ্বালায়।
তুলসী গাছের পাতাতেও তিস্তার পলি। দুই দিন মাছ ধরা নাই। কামাই ধান্দা বন্ধ রেখে
সরোর সঙ্গে হাসিরাম ও বাড়ি পরিষ্কার করেছে। ঘরের বেড়া বেঁধেছে, উনুন বানিয়েছে। কুয়োর জলের অবস্থা খারাপ
তাই স্কুল থেকে জল টেনে এনেছে। আজমল হাসিরামের থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিল মহরম
কমিটির সঙ্গে ফুরফুরা শরীফ যাবে বলে বাস ভাড়া হিসাবে। কিন্তু সব তিস্তার জলে গেল।
হাসিরামের এই বাড়িঘর ঠিক করতে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু সবার যা অবস্থা এখন
মিন্টুর কাছে চায় কি ভাবে হাসিরাম। এখন চাইলেও কেউ টাকা হাওলাত দেবে না।
রাতের দিকে আজও সরকারি রিলিফের খাওয়ার
ব্যবস্থা হয়েছে টাকিমারীর প্রাইমারি স্কুলে। মিঠুনকে নিয়ে এসেছে হাসিরাম। মিঠুনের
চোখ ঘুমে ভেঙে যাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আজমলের বিবি আসিফা ওর দশ বছরের ছোট মেয়েটাকে রেজিনাকে খাওয়াচ্ছিল। মিঠুনকে দেখে
ওকে ডাকে,"মিঠুন এই দিকা আয়"। এক থালার থেকে খিচুড়ি
খাওয়াতে শুরু করে মিঠুনকেও ওর মেয়ে রেজিনার সঙ্গে। হাসিরাম সরো আর বুলির জন্য
খাওয়ার নেওয়ার লাইনে দাঁড়ায়। ভোটের পর এই অঞ্চলে শহরের নেতাদের আর দেখা যায়না।
খবরের কাগজে শুধু শহরের বন্যার খবরই ছাপায়, গাজলডোবা শুধু ঘুরতে
আসার জায়গা মালো পাড়ায় কি আর মানুষ থাকে! শুধু মাথা গুনতি ভোট থাকে। হাসিরাম
রফিককে বলে," তোমাদেরকে ভোট দিবারও লাইন, খিচুড়ি নিবারও লাইন, আমরা শুধু লাইনেই দাঁড়াব।"
হাসিরাম দাঁড় টানতে টানতে পাহাড়ের দিকে
তাকিয়ে অনিন্দ্যকে বলে," শুনছি ওই পাহাড়ের বরফের সাদা চূড়া পার হয়ে আসে পাখির দল এই দ্যাশে। লাদাখ
না মঙ্গোলিয়া থেইক্যা!" অনিন্দ্য বলে "ঠিকই শুনেছ তুমি।" "কেন
আসে পাখিরা এইখানে নিজের দেশ ছাইরে?" হাসিরাম
অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করে। অনিন্দ্য ব্যাখ্যার মধ্যে না গিয়ে চুপ করে থাকে। হাসিরাম
বলতে থাকে, "ওই পাখি গুলোর মতোই আমাদের জীবন দাদা,
কোন দ্যাশ থেইক্যা আসে কোথায় অন্য কোন দ্যাশে" অনিন্দ্য
বিস্ময়ের চোখে তাকায় হাসিরামের দিকে। হাসিরাম বলে,"পাখি
গুলা জলে জলেই ঘুরে বেড়ায় আমাদের মত, যখন যেখানে থাকে
সেটাইরেই নিজের দ্যাশ বলে মনে করে।"
ঘাটের সামনে এসে হাসিরাম নৌকা থেকে হাঁটু
জলে নেমে নৌকা নোঙর করে। নৌকার সামনের দিকটা চেপে ধরে হাসিরাম। অনিন্দ্য নৌকা থেকে
ক্যামেরা সামলে নীচে নামে। হাসিরাম অনিন্দ্যকে বলে, "ভাবছিলাম একটু বড় করে ছাউনি দিয়া
একটা নতুন নৌকা বানাব কিন্তু শ্রাবণ মাসের বানে আমাদের সব ভাইসা গেল!"
অনিন্দ্য পকেট থেকে পার্স বের করে টাকা দেয়ার জন্য, বলেন,
"সামনের রোববার আবার আসব, এরপর পাখিদের
যাওয়ার সময় হয়ে যাবে!" হাসিরাম বলে,"এই যে আপনারা
শহর থেকে আসেন, পাখির ছবি তোলেন আবার শহরে চলে যান। শীত শেষ
হলে পাখিগুলোন কোথায় যায় কি করে সেই খবর কি কেউ রাখে?" অনিন্দ্য
মুচকি হাসেন। হাসিরাম বলে,"আমাদের অবস্থা পাখি গুলার
মত। ভোট আসলে নেতা গুলো আসে। তারপর আর সারাবছর পাত্তা নাই। শ্রাবণ মাসের বন্যার পর
টাকিমারী চরের মানুষ বাঁচল কি মরল! ওরা শুধু মাথা গোনে আর ছবি তোলে মানুষের,
একটা মাথা একটা ভোট! আমাদের কোনো দ্যাশ নাই, আমাদের
কোনো বাড়ি নাই!" ব্যারেজে পাখির ছবি তুলতে আসা মানুষের দল আর ভোট চাইতে আসা
মানুষ কোনোদিন খোঁজ রাখে না কার কোনটা দেশ।
পাহাড়ের ওই পারে থাকা অন্য এক রূপকথার
দেশ থেকে আসে চখা চখির দল গজলডোবা ব্যারেজে। দিনের বেলায় পাহাড়ের ছায়া পড়া নদীর
নীল জলে ঘুরে বেড়ায় পাখির দল। তিস্তার পশ্চিমে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে সূর্য ডুবলে নদী
পাহাড়ের অরণ্যের উপর পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে। রাতের বেলায় টাকিমারী চরে চখা চখি জোছনা
পান করে রূপকথার গল্পে।
তারপর নিশ্চিন্তে ঘুম যায় পরস্পরকে বুকে
জড়িয়ে। কোন পাট্টা, পরচা, বৈধ পরিচয়পত্র থাকা না থাকার দুঃস্বপ্ন সেই
ঘুমের গভীরে নেই।
" আমরা পেটের ধর্মে
ভেসে বেড়াই বাবু। যেই দ্যাশ ভাত দিল, সেই দ্যাশ আমার মা কী
না কন! হেই তিস্তা আমার মা কী না কন!"
অনিন্দ্য কথা খুঁজে পায় না---- লেন্সের
ভিতর দিয়ে অনেক দূরের আবছা সীমান্তের দিকে কী যেন খুঁজতে থাকে একমনে।
No comments:
Post a Comment