Tuesday, December 24, 2019

সুবিনয় হেমব্রম





আমি কোনটা বলব?


আমি কোনটা বলব? কুয়াশা টুয়াশা নিয়ে বলতে পারি, স্পষ্টতার বিরুদ্ধে তার যুক্তি আছে। স্পষ্টতারও স্পষ্ট বক্তব্য আছে। আমি উচ্চতার কাছে নতজানু হতে পারি। মধ্যমের কাছে পাততে পারি অক্ষমতা। নিম্নাঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে ভরসা পাই। কিন্তু  দুটো যুক্তির মাঝে তো অবস্থান করা যায় না। দুটো যুক্তি একসঙ্গে নিয়ে চলাও যায় না। বেড়িয়ে আসা যায় কী?
দেশের মানুষের স্বার্থে দেশের সরকার কাজ করবে, এটা হল দস্তুর। একটি দেশ চরিত্রগতভাবে এক্সক্লুসিভ ও ইনক্লুসিভ দুইই হতে পারে। কী হবে তা নির্ভর করে দেশের মানুষের সাধারণ প্রবণতার ওপর। ভারত বলি না আমি।  বলি দক্ষিণ এশিয়া। তক্ষশীলা গান্ধার থেকে বালি জাভা পর্যন্ত আমার দেশ। সেই দেশের সাধারণ প্রবণতা ইনক্লুসিভনেস।  রাজনৈতিক সীমানা একটা সাময়িক ব্যাপার। রাজনীতির বদল হয়। একটা বড় সময়ের ভিত্তিতে  যদি ভাবা যায়, তো দেশের বর্তমান সীমানা নিয়ে মাথা ঘামানো একটা সস্তা রসিকতা হয়ে যাবে। ভারত নামক দেশটি বর্তমানে আফগানিস্তান পাকিস্তান ইন্ডিয়া বাংলাদেশ মায়ানমার থাইল্যান্ড কাম্বোডিয়া লাওস ইন্দোনেশিয়া বালি জাভা সুমাত্রা প্রভৃতি নানান রাষ্ট্রর বিভক্ত হওয়ার পর, আর এই নামে কোনও দেশ পৃথিবীতে নেই। ভারত কি ছিল কখনও? না দেশ বলতে যা বুঝি আমরা সেই ধারণার প্রেক্ষিতে ভারত ছিলও না কোনওদিন। গোটা ভারত ইতিহাসের কোনও কালেই এক শাসকের অধীনে আসেনি। আসা প্রয়োজন? না, প্রয়োজনও নেই। সংস্কৃতির রাষ্ট্র লাগে না। আর্যরা এদেশে আসুক, অথবা এদেশ থেকে ক্রমপ্রসারিত হোক, ভারতীয় সংস্কৃতি ভাষা কোনওটিই কিন্তু বিশুদ্ধ আর্য সংস্কৃতি নয়। বলা বাহুল্য আর্য বলতে আমি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা সংস্কৃতির কথা বলছি। ইয়োরোপীয় বা  ইরাণীয় ভাষা সমাজ ও সংস্কৃতিতে পাওয়া যায় না, এরকম অনেক বৈশিষ্ট্য ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতি ও ভাষায় আছে, যারা ভারতকে একটি বিশুদ্ধ আর্য সংস্কৃতির দেশ হতে বাধা দেয়। ভারতীয় ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির ফোনোলজিতে এমন কিছু কিছু ধ্বনি আছে, যা ইয়োপীয়, ইরাণীয় মানে আর্য সংস্কৃতি প্রসারের বাকি এলাকাগুলির ভাষায় নেই। যেমন রিট্রোফ্লেক্স ট ড ণ ইত্যাদি। জিভকে সোজা তুলে লোয়ার প্যালেটে দৃঢ়ভাবে স্পর্শ করে হাওয়া ছাড়লে উচ্চারণের ইংরেজি 'T' সাউন্ড। বাংলা বা হিন্দি বা ভারতের যেকোনও ভাষায় 'ট' কিন্তু একই ইংরেজির T এর মতো নয়। ট উচ্চারণ করতে জিভকে গুটিয়ে টাগরায় স্পর্শ করতে হয়। এটা একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। আর কোনও ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষায় এরকম ধ্বনি নেই। তাহলে ভারতীয় ভাষায় তা এলো কীভাবে? এমনকি এই বৈশিষ্ট্য দ্রাবিড় ভাষারও না। দ্রাবিড় ভাষাগুলিতে এই রিট্রোফ্লেক্স ফোনিম কখনো তীব্র হয় না। যতটা তীব্র অস্ট্রিক ভাষাগুলিতে। সুতরাং বলাই যায় এই বৈশিষ্ট্য হল অস্ট্রিক ভাষার প্রভাব সংস্কৃত ভাষার ওপর। খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১৩০০ অব্দ নাগাদ অ্যাসিরিয়ায় গড়ে উঠেছিল মিত্তানি রাজত্ব। সেখানকার ক্লে ট্যাবলেটের ভাষা ঋগ্বেদের দুএকশ বছরের পার্থক্যসহ সমসাময়িক। মজার কথা সেখানেও কিন্তু রিট্রোফ্লেক্স ফোনিমটি নেই।  যেহেতু বাকি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাভাষী এলাকায় অস্ট্রিক ভাষাভাষী মানুষজন নেই সুতরাং এই বৈশিষ্ট্যও নেই। ঋগ্বেদের ৪ শতাংশ শব্দই নন ইন্দো-ইয়োরোপীয় শব্দ। এবং তারা এসেছে প্রাগার্য ভারতীয় ভাষাগুলি থেকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট গবেষক মাইকেল উইটজেল "Substrate Languages in Old Indo-Aryan (Rigvedic, Middle and Late Vedic)" নামক একটি গবেষণা পত্রে ২০১২ -তে সেইসব শব্দের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা  প্রস্তুত করেছেন। ককম্বীর (একটি গাছের নাম), ককর্দু (লাঠি), কীনাশ (চাষি), কুলায় (বাসা) ইত্যাদি শব্দ সেই তালিকায় পাওয়া যায়, যা মুণ্ডারি ভাষা এবং আরও এমন কিছু প্রাগার্য ভাষা থেকে এসেছে, যাদের অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে গেছে। এগুলি সংস্কৃত শব্দ নয় কিন্তু খোদ ঋগ্বেদে আছে। এই একই রকম অনন্যতা ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির মধ্যে আরও অনেক আছে, যা এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। সামাজিক গঠনে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য সমাজে যে জাতিভিত্তিক বিভাজন, তা বহির্ভারতের আর্যভাষী এলাকার সামাজিক গঠনে পাওয়া যায় না। কেউ বলতে পারেন, ক্রিশ্চানিটি আসার ফলে ইয়োরোপে এই জাতপাতের বিভাজন দূর হয়ে গেছে। কিন্তু তা নয়। কারণ, গ্রীক ও রোমান ধর্মে পুরোহিত শ্রেণির উপস্থিতি ছিল। কিন্তু তা বংশানুক্রমিক ছিল না। তবে, এই তর্কের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইরাণীয় সমাজের গঠন। যদিও ইরাণীয় শব্দটির ব্যবহার এক্ষেত্রে একেবারেই ভুল হল। ইসলাম আসার পর পারসিক সভ্যতার খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে সেখানে। সঠিক শব্দটি হবে 'আবেস্তান'। তো সেই আবেস্তান বা জরাথ্রুস্টিয়ান সমাজেও জাতিভেদ স্বীকৃত হয়নি। আমরা জানি, ঋগ্বেদ ও জেন্দাবেস্তা দুএকশ বছরের পার্থক্যসহ মোটামুটি সমসাময়িক। জাতিভেদ যদি একটি বিশুদ্ধ আর্য বৈশিষ্ট্য হত, তাহলে অন্তত আবেস্তান সমাজও সেই চিহ্ন বহন করত। কেউ কেউ বলতে চান যে বৈদিক সমাজ জাতিভেদমুক্ত ছিল। কিন্তু তা সত্যি নয়৷ বরং ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে জাতিভেদের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে সেই বিখ্যাত পুরুষসুক্তে। দশম মণ্ডল পরের দিকের মণ্ডল এরকমটাও বলতে চান অনেকে। কিন্তু ঘটনা হল, অন্যান্য স্তুতিমূলক মণ্ডলগুলিতে পূর্বপুরুষের বীরত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে সমাজ নিয়ে উল্লেখের স্কোপ ছিল না। কিন্তু যখন দশম মণ্ডলে ঋগ্বেদ ভারতীয় সমাজ ও দর্শনের অন্তর্নিহিত মূল সূত্রগুলি ধরতে শুরু করেছে তখনই সে জাতিভেদকে রেজিস্টার করে নিয়েছে, তার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে। তো এলো কোত্থেকে এই বৈশিষ্ট্য। আর্য বৈশিষ্ট্য এ নয়। হলে বহির্ভারতের বাকি আর্যভাষী মানুষদের মধ্যেও একই লক্ষণ দেখা যেত৷ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় অস্ট্রিক জাতি সান্তাড় সমাজের গঠনটা এবার দেখুন: একই গঠন। এখানেও কিস্কুরা ক্ষত্রিয়,  মুর্মুরা পুরোহিত, হেমব্রমরা মসীজীবী, সরেন সৈনিক, মান্ডি কৃষক এবং এগুলি বংশানুক্রমিক। এই জাতিগুলির মধ্যেও আবার নানান উপবিভাগ আছে। সাদা হেমব্রম, কাডা হেমব্রম ইত্যাদি। এবং সমগোত্রে বিবাহ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মনে হয় না যে ব্রাহ্মণ্য সমাজের ওতোপ্রোত বৈশিষ্ট্য আসলে অস্ট্রিক সমাজজাত? এটাই ভারত। ভাষায় সংস্কৃতিতে সামাজিকতায় রিচুয়ালস ও বিশ্বাসে মিলেমিশে যাওয়াই ভারত। মিলমিশ এখানে শুরু হয়েছে সেই ঋগ্বেদ থেকেই। একটি দেশ এক্সক্লুসিভ হতেই পারে প্রবণতার দিক থেকে। কিন্তু ভারত তা নয়। ভারত ইতিহাসের প্রথমদিন থেকে ইনক্লুসিভ। অস্ট্রিকরা এদেশে এসেছে ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড কাম্বোডিয়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে, নাকি ভারত থেকে বেরিয়ে ওখানে গেছে, এই নিয়ে তর্ক আছে। আর্যরা এদেশে এসেছে, না ভারত থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে বাকি পৃথিবীতে তর্ক আছে তা নিয়েও৷ এমনকি দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা কোথা থেকে এসেছেন, সেই নিয়েও তত্ত্ব ও তর্ক অপ্রতুল নয়। কিন্তু যা নিয়ে তর্ক নেই, তা হল, মাইগ্রেশান। মানুষের যাতায়াতে এই ভূখণ্ড চিরকালই মুখরিত। মেহেরগড় হরপ্পার দিনগুলোতেও মানুষ ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করেছে। হরপ্পার কোনও একটি সাইট এক দেড়শ বছরের বেশী স্থায়ী হয়নি। বারবার পরিত্যক্ত হয়েছে এক একটি সাইট। আবার বসতি স্থাপন করেছে মানুষ। আবার ছেড়ে চলে গেছে, অন্যেরা এসে সভ্যতা রচনা করেছে। হরপ্পার একেবারে শেষ স্তর থেকে পাওয়া প্রত্ন উপাদান স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে এর শুরু আর শেষ একই মানুষের হাতে ছিল না। হাত বদল হয়েছে। দূর দুর হেঁটে গেছে মানুষ গাধার পিঠে বাণিজ্য চাপিয়ে। মিশরের তুলোয় পোশাক বানিয়েছে সিন্ধু উপত্যকার মানুষ। আবার তাদের তৈরী পুতির মালা পাওয়া গেছে মেসোপোটেমিয়ায় রাজার সমাধিতে। হরপ্পার তৈজসপত্র মিলেছে সেই ওমান সমুদ্র উপকূলের গভীর মাটিতে, আবার এই বাংলার কৃষ্ণ নগরে এসে বিশ্বখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ জে এম কেনোইয়ার খুঁজে পাচ্ছেন হরপ্পা রীতি তৈরি শাঁখা! সিঁথির সিঁদুরের কথাই ভাবুন। বিখ্যাত দ্রাবিড়োলজিস্ট অস্কো পারপোলা বা প্রফেসর বিবি লালের মতো প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রমাণ দিচ্ছেন যে হরপ্পার সময়কার মহিলারাও সিঁথিতে সিঁদুর দিত। তারা আজও দেয়। শুধু হিন্দুরা নয়। মুণ্ডা শবর সান্তাড় দ্রাবিড় ভারতের যেকোনো জাতি যেকোনো ভাষাগোষ্ঠীর যেকোনো মহিলা গত পাঁচহাজার বছর ধরে শাঁখা সিঁদুর দিয়ে প্রসাধন সারছেন। এদেশে এমনকি মুসলিম মহিলারাও কপালে লাল টিপ পরার আগে দ্বিধাবোধ করেন না৷ এটাই ভারত। সংস্কৃতজাত একটি ভাষা হিন্দি নাকি হিন্দুর ভাষা, সেই সংস্কৃতজাত উর্দু আবার মুসলিমের। এখানে কী নিয়ে লড়াই করবেন আপনি? ভারতবর্ষ যুদ্ধক্ষেত্র নয়। গরিব কিন্তু ভারত হল অনুপম ভালবাসার ল্যান্ড। আতিথেয়তার দেবভূমি। বস্তুত, এখানে দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে ছাড়া উপায় নেই। হয়তো রাজনৈতিকভাবে ভারতবর্ষ আজ আর নেই। কিন্তু তার বাকি সব আছে। তার সংগীত, চিত্রকলা, নাট্যতত্ত্ব, দর্শন, ভাষা,  বিশ্বাসে ভারত একই আছে। বর্তমান রাজনৈতিক যে সীমানা, তা তো কোনও সায়েন্টিফিক অ্যাবসলিউট কিছু না। এবং যে বড় সময়কে নিয়ে আমরা ভাবছি, সেখানে এই সীমানাগুলি বড়ই সাময়িক। কোনও কিছুই চিরস্থায়ী হতে পারে না। হতেই পারে, আজ যে বিস্তৃত সীমা নিয়ে ভারতবাসী গর্ব করে, আগামী পঞ্চাশ বছরে সেখানে ২৯টা ছোট ছোট রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। আবার এটাও হতে পারে যে পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একটাই রাষ্ট্রীয় সীমানা থাকবে। আজ যেভাবে ইয়োরোপ জুড়ে একটাই কারেন্সি চলছে, অর্থনীতি এক হয়ে গেছে, কাছাকাছি আসছে তারা সহযোগিতা বাড়ছে ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির মধ্যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা কেউ ভাবতে পারত? ফলে কী হবে আগামী পঞ্চাশ বছরে এই পৃথিবীতে, কেউ আন্দাজ করতে পারে না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবে না। কোনও মাটি কারও নয়। যে যেখানে আছে, যে যেখানে ভালবেসে সংসার পেতেছে, সেটাই তার মাটি সে যতদিন ভালবেসে এখানে থাকতে চাইবে ততদিনই। সে চলে গেলে অন্য কেউ আসবে। এটাই নিয়ম। এটাই ন্যায্য। এর বিরুদ্ধে যা কিছু, তা অন্যায়! এই আমার স্পষ্ট অবস্থান।
কিন্তু সময়টা তো এরকম স্পষ্ট নয়। আর সময়কে অস্বীকারও করা যায় না। আজকের সময়ে ভারত একটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক সীমা। এই সীমার মধ্যে বসবাসকারী মানুষদের প্রতি এর সরকারের দায় যে, সে তাকে সুরক্ষা দেবে, সে তাকে উন্নততর জীবন যাপনের জন্য সহায়তা করবে। আর যার উন্নতি করব আমি, তাকে না চিনলে উন্নতি করাও যায় না।
তাই নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার সদিচ্ছা যদি কোনও সরকার দেখায়, তা সাধুবাদযোগ্য। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে,  'ভারত' যেমনভাবে সত্য। পাকিস্তান বাংলাদেশও সত্য। আর এখানকার সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উৎপীড়নে বিধ্বস্ত হয়ে নিরুপায় ভিটেমাটি ছেড়ে হাজারে হাজারে পালিয়ে আসাও সত্য। এটাও সত্য যে ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। ও পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে যাদের অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিটেছাড়া, তারা মুসলিম। সত্য যে এদেশে স্বাধীনতার পর থেকে আজও পর্যন্ত বহু মুসলিমও আবার মূলত বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। সুতরাং কেউ যদি যুক্তি দেন যে, 'মুসলিমদের ওপর তো কোনও নিপীড়ন নেই, তারা তাদের দেশ ভাগ করে নিয়েছে, তাহলে কেন ফের তারা এখানে আসবে!' অপর দল বলবেন, 'আসতে দিলে কেন! সীমান্তে তাদের আটকাওনি কেন! এসে যখন পড়েছে, জায়গা দিতে হবে!' না এর কোনওটাই কোনও গ্রহণযোগ্য  যুক্তি নয়। সেনাবাহিনী যদি মারাত্মক আগ্রাসী হয়ে ওঠে সীমান্তে, তা দিয়েও জনস্রোত আটকানো যাবে না। কিন্তু ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অর্থাৎ  মাইগ্রেশান আটকানোর ভার শুধু সেনাবাহিনীর হাতে ছাড়া যায় না। সেনাবাহিনী একশটা লোককে একরাতে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে না। তাহলে উপায়? অনুপ্রবেশ আটকাবে না একটা দেশ? দেশটা কি ধর্মশালা? ধর্মশালা নিশ্চয়ই  নয়, তো উপায় কী হবে? যারা এদেশে আসছেন, হয়তো ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার নন সকলে, নিপীড়ন কি শুধু ধর্মীয়ভাবেই হয়? তার যদি নিজের এলাকায় কাজ না থাকে, সে যাবে  না অন্য জায়গায়? তুমি ব্রেকফাস্টে নলেনগুড়ের সন্দেশ খেয়ে, গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে সাহিত্য সম্মেলনে যাবে, আর একজন না খেয়ে থাকবে সীমান্তের ওপারে বউবাচ্চাসহ: এটাও তো ঠিক যুক্তি নয়! কিন্তু ক্রমাগত যদি অন্য দেশ থেকে লোকজন আসতে থাকে, তাতে তো সেই দেশটির অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাবেই। যে অঞ্চলে আসছে তারা, সেখানকার আদি বাসিন্দাদেরও তো আপত্তি থাকতে পারে, সেখানে উত্তেজনা তৈরি হলে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাহলে কী করা যাবে? হ্যাঁ, অনেক অনেক এরকম যুক্তি আছে। প্রতিটা যুক্তির ভিত্তি আছে। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাওক্রম জানা আছে নাজানা আছে, অনেক স্পষ্টতা অস্পষ্টতা আছে। যে সরকার এই নাগরিক পঞ্জি নিয়ে যে সময়ে উদ্যোগ নিচ্ছে, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তাদের অব্যবহিত অতীতের কার্যকলাপের কারণেই। আবার তাদের শক্তি সঞ্চয়ের নেপথ্যে ভারতের বাকি দলগুলি ও ইন্টেলেকচুয়ালদের দায় আছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন সময়ে করেছে। যথার্থ আদর্শবাদী দল ভারতে বাম অবাম কেউ নেই। সংখ্যালঘুকে ভোটব্যাংক বানানোর চেষ্টা কমবেশি সকলেই করেছে। এমনকি যারা নির্বাচনের রাজনীতির ভাগীদার নয়, সেই সব অতিবাম বিপ্লবী দলগুলিও মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে আশ্চর্যজনকভাবে। একটি অতি ডানপন্থী দল গড়ে ওঠা ও তাদের পক্ষে এদেশের সংখ্যাগুরুকে ভীতিগ্রস্ত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেই পরিসরেই। উলটোদিকে যখন দেশের সরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যবিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে হুমকির সুরে  বলেন, 'এনআরসি হবেই হবে!' তখন আদৌ এ কোনও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নাকি নেহাতই ভোটের রাজনীতি, তা নিয়ে সংগত প্রশ্ন আছে। অনুপ্রবেশ যদি সমস্যা হয়ও, তার সমাধান এই পদ্ধতিতে আছে কিনা, এই সংশয় সেই কারণেই গুরুতর! ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা! অসংখ্য প্রশ্ন। কোনওটিরই একটা উত্তর নয়। কোনও প্রশ্ন কোনও উত্তরই উড়িয়ে দেবার নয় যদি আমি যুক্তিতে আসি।
আমি কোনটা বলব? দুটো যুক্তির মাঝে অবস্থান করা যায় না। যুক্তি থেকে বেড়িয়ে আসা যায় কী? আমার ধারণা ওটাই পথ! জীবনের সবকিছু যুক্তিসঙ্গত মোটেও নয়। ভালবাসা আবেগ মানবিকতার কাছে যুক্তিকে সংযত থাকতেই হয়। আপনার আমার অনন্ত স্বার্থপরতারও তো যুক্তি নেই। হাজার শিশু নিরন্ন জেনেও আপনি নিজের শিশুকে বাটার কিনে খাওয়ান! যুক্তি দিয়ে? কোন যুক্তিতে আপনি আপনার শিশুর মুখচুম্বন করেন, যখন হাজার অপুষ্ট শিশু একফোঁটা দুধের অভাবে মারা যাচ্ছে প্রতি রাতে! কোন যুক্তিতে নরম লাল ফুলোফুলো জ্যাকেট পরিয়ে মেলায় নিয়ে যান আপনার শিশুকে, তিনশ-টাকা-কাপ হট চকোলেট কিনে দেন, যখন মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে রাস্তায় খেলা করা শিশুদের গায়ে একটা সুতো নেই! যুক্তি আছে?
যুক্তি নেই আপনার নিজের আচরণে। অথচ এর বাইরে আপনি বেরুতেও পারেন না। কারণ আপনি ভালবাসেন আপনার শিশুকে। নিজের শিশুর প্রতি আপনার যে আবেগ, প্রতিবেশী শিশুটির প্রতি আপনার সেই আবেগ নেই। আর নেহাতই নিম্নমধ্যবিত্ত আপনার সামর্থ্য নেই, হাজার কেন একশ কেন, আর একটা শিশুরও মুখে খাবার তুলে দিতে। আপনি অসহায়। আপনাকে চোখ বুজে থাকতেই হয়। এক্ষেত্রে তো যুক্তি মানেন না আপনি। মানলে আপনার শিশুর খাবারটি সব অভুক্ত শিশুকে ভাগ করে দিতেন।  তাহলে আবার কেন যুক্তি দিয়ে আপনি দেশের  সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্টকে সমর্থন করবেন!  কীসের যুক্তি! যুক্তির প্রসঙ্গই আসে না।
সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্টের কোনও পরিকল্পনার পক্ষে আমি কোনও যুক্তিই মানব না। যুক্তি আবার কী? মানবিকতা যুক্তি নির্ভর নয়। মানবিকতা ভালবাসা নির্ভর। আবেগ নির্ভর। আমার ভারত ইনক্লুসিভ। আমি গ্রহণের পক্ষে, বর্জনের নয়। বর্জনের পক্ষে কোনও যুক্তির ধোঁয়াশায় আমি নিজেকে জড়াতে চাই না। বর্জনের সমর্থক কারও সঙ্গে আমার কোনও যুক্তি তর্ক বিদ্বেষ আলোচনা কিচ্ছু নেই। আর তাছাড়া যুক্তি তো একটা মানবিক ব্যাপার। মানুষ ছাড়া অন্যকোন প্রাণী কি যুক্তি দেয়? তারা প্রবৃত্তিতে চালিত হয়। তারা কোনও তথ্য মনে রাখে কি? রাখে না। সুতরাং যুক্তি তথ্য জিনিষটাই যেহেতু একান্তভাবে মানবিক প্রক্রিয়া, অমানবিকতার পক্ষে কোনওভাবেই তাকে দাঁড় করাতে আমি রাজি নই।
সমস্যা যদি থাকে, সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যখনই আমরা ভাবি যে, এটাই ঠিক, আর বাকি সব ভুল,  আর কোনও দ্বিতীয় উপায় নেই, এরকম ভাবনা থেকেই মৌলবাদের জন্ম হয়। দেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী কারও প্রতি কোনও অমানবিক আইনের পক্ষে বিপক্ষে কোনও যুক্তিই আমি শুনব না। সেই যুক্তি তথ্য সঠিক হলেও মানব না। কারণ ভারতীয় হিসেবে আমার আবেগকে তা আঘাত করে। আপনার শিশুর প্রতি আপনার যদি যুক্তিহীন আবেগ থাকতে পারে, আমার যুক্তিহীন আবেগেরও মূল্য থাকলে দোষ? হিন্দুর প্রতি আপনার যদি আবেগ থাকে, তো যান হাজার হাজার দারিদ্র্যক্লীষ্ট হিন্দু শিশু সারা ভারতে না খেয়ে মরে যাচ্ছে শীতের রাতে, তাদের ভাতের ব্যবস্থা করুন, তাদের গায়ে লাল ফুলোফুলো জ্যাকেটের ব্যবস্থা করুন। হ্যাঁ, আমার কমিউনিটির প্রতি আমার আবেগ আছে। আপনারও যদি কোনও কমিউনিটি-ফিলিং থাকে, ভাল! অন্য কমিউনিটিকে আঘাত না করে কাজ করুন নিজের কমিউনিটির জন্য। একজন মুসলিমকে আঘাত না করে একজন হিন্দুকে সাহায্য করাটা অনেক বড় হিন্দুত্ববাদ! আরএসএসের চেয়ে সেই কারণেই ভারত সেবাশ্রম সংঘ অনেক বেশী হিন্দু সংগঠন।
আর ভারত? সে কোনও ভৌগোলিক রাজনৈতিক সীমা নয়। ভারত একটি সংস্কৃতি, একটি অনুপম জীবনবোধ।  সেই জীবনবোধের চর্চাকারীই সত্যিকার সবচেয়ে মহান ভারতীয়, রাজনৈতিক ভাবে সে আজ হয়তো ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দা বাংলাদেশের  বাসিন্দা, বা ইন্ডিয়ার কোনও স্টেটে থাকে, হয়তো সে নিজেকে ভারতীয় বলে জানে না। জানে না ভোরের আজানে সে ভৈরবের সুর ভাঁজে। তার অজানিতেই হয়তো আরবি সুরে এসে  লাগে কোমল রেখাব। কারণ সে তো ভারতীয়। আজ চেনে না, কাল সে চিনবে নিজেকে। তাকে এলিমিনেট করব আমি ভারতীয় হয়ে? তাকে দেশহীন করে দেব? যুক্তিতর্ক তথ্য ও রাজনীতি দিয়ে? মানুষ হিসেবে ভারতীয় হিসেবে লজ্জা পাব না?

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ