মৎলেব কাকা
মৎলেব কাকার পুরো নামটা বাবার কাছ থেকে আমার জানা হয়
নি। বাবার তুলনায় ওঁর গায়ের রঙ ছিল বেশ
ফর্সা ; আমার চোখে উনি খুব লম্বা, সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে প’ড়ে পথ চলতেন। বাবার
সহকর্মী উনি ছিলেন না, আবকারী বিভাগে কাজ করতেন। শুনেছি, কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গে থাকা্র সময় থেকে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে পরিচয় হয়,
যা মৎলেব কাকার মৃত্যু পর্যন্ত অক্ষত ছিল। আমি যখন জগৎসংসার সম্পর্কে ধাপে-ধাপে সব
জেনে ফেলছি, তখন বাবার জীবনে স্মৃতিচারণার বয়স এগিয়ে আসছে, বাবা গর্বসহকারে বলত,
তখনকার দার্জিলিঙের গোটা এক্সাইজ় বিভাগে সম্ভবত মৎলেব-ই ছিল একমাত্র সৎ অফিসার!
বর্দ্ধমান জেলার কোথাও-একটা মৎলেব কাকাদের গ্রামের বাড়ি, সেখানেও আমরা দুদিনের
ছুটি কাটিয়ে এসেছি । আমার ওপর রাগ ক’রে মা পরে জ্যাঠাইমাকে বলেছিল, এত অসভ্য ছেলে,
মেজদিদিভাই, ওঁদের সামনে আমি মুখ দেখাতে পারলাম না, পুরোটা সময় মুরগির পেছনে ছুটে-ছুটে
কাটাল!
ছয়ের
দশকের মাঝামাঝি, কোন অকারণে কে জানে, দাঙ্গা বাঁধল কলকাতায় । ইস্কুল খোলার পর ফিরে
এসে দেখি, মৌলালির মোড়ের মস্জিদের রাস্তার দিকের দেওয়ালটা কালো হয়ে গেছে । একটু
কালো আগেই ছিল ধোঁয়ায়, কারণ ওটা ছিল মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখবার জায়গা, সেজ্দা দেবার
জায়গা । এই কালো অন্যরকমের কালো । এ-নিয়ে বাবাকে আমি কোনও প্রশ্ন করি নি, কারণ
ততদিনে জগৎসংসার সম্পর্কে আমি আরও অনেক জেনে ফেলেছি । এর পরে একদিন, বাবা, মা আর আমি আবার গেলাম মৎলেব কাকাদের
বাড়ি । মা ভেতরের ঘরে চ’লে যাবার পর মৎলেব
কাকা বললেন বাবাকে, কড়েয়া থানার লাগোয়া এই বাড়িটা ভাড়া নিলাম, বুঝলেন । ওনার শরীর
ভাল থাকে না, ছেলে মেয়েরাও বুঝতে শিখছে; আগে থেকে ভেবে রেখেছি, এবার কিছু হলে,
সপরিবারে লক-আপে ঢুকে ব’সে থাকব। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, মিষ্টান্নের রেকাব হাতে,
বাবা মাথা নীচু ক’রে ব’সে আছে । আমার দিকে ফিরে মৎলেব কাকা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা,
তোমাদের স্কুলের কাছে ওই মস্জিদ কি ওভাবেই প’ড়ে আছে? কেউ আবার রঙ করে নি? প্রথমে
আমি সংক্ষেপে বললাম, হ্যাঁ । তারপর মাথা নেড়ে বললাম, না । জগৎসংসার-বিষয়ে অভিজ্ঞ,
আমিও বাবার মতো মিষ্টান্নের রেকাব হাতে মাথা নীচু ক’রে ব’সে রইলাম ।
No comments:
Post a Comment