তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী! – আমাদের অতিরাষ্ট্র-যাত্রা
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের ভারত – প্রায়
আক্ষরিক অর্থেই আসমুদ্র হিমাচল – ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে উত্তাল নাগরিকত্ব সংশোধনী
অ্যাক্ট এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে। সর্বস্তরের মানুষ
বর্ণ-ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ পথে নেমেছে। বিদ্রোহে আন্দোলনে সামিল
হয়েছে। এবছর আগস্ট মাসের শুরুতে ভারত কাশ্মীরে ৩৭০ এবং ৩৫এ
ধারা বিলোপ নিয়ে (সর)গরম ছিল। শুধু তাই নয়, ২০১৯-এর
নির্বাচনোত্তর
পর্বে পশ্চিমবঙ্গে আবার অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেল। আসামের একটি ১৮ বছরের মেয়ে
দ্বিতীয়বারেও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা NRC-তে নাম ওঠাতে না
পারায় আত্মঘাতী হল। ঝাড়খণ্ড সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি খোদ পশ্চিমবঙ্গে,
ভিন্ন ধর্মের মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে বিশেষ “নামধ্বনি”-র সাথে সংযুক্ত করে,
এক বিশেষ শ্লোগানকে ভিত্তি করে। আমাদের
রাষ্ট্র এবং নাগরিকতা নিয়ে আবার প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিল। নতুন করে বোঝাপড়ার এক
পরিসর উন্মুক্ত হল আবার। এরকম এক পরিস্থিতিতে “নাগরিকত্ব” বিষয়টি আমরা আরেকবার
ভেবে দেখতে পারি। পর্যালোচনা করতে পারি।
ভোটের পরে পরিস্থিতির পেছনে হেঁটে আমরা সম্যক উপলব্ধি
করছি একজন শক্তিমান রাষ্ট্রনেতা, শক্তিশালী সামরিকীকৃত ভারত, গরিষ্ঠের স্বরকেই
সমাজের একমাত্র স্বর করে তোলা এসমস্ত বিষয়গুলোকে বাছাই করে কয়েক বছর ধরে নিঃসারে,
জনসমাজের একেবারে গোড়া থেকে ধীরে ধীরে একটি সোশ্যাল সাইকি বা সামাজিক মানসিকতা
নির্মাণ করা হয়েছে। এরকম এক পরিস্থিতিতে “রোটি, কাপড়া ঔর মকান” তুচ্ছ হয়ে যায়।
আমরা এগুলো কিছু অনুমান করতে পারিনি। কেবলমাত্র তাত্ত্বিক স্তরে সীমাবদ্ধ থেকেছি।
ঘটনা পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেছি। ঘটনার আগাম অনুমান আমাদের কাছে ছিলনা।
নির্বাচন পরবর্তী যখন শুনি কোন নেতার মুখে “মোদীই আমাদের সুপ্রিম কোর্ট” তখন বড়ো
আতান্তরে পড়ে যাই। এতো পার্টি-রাষ্ট্র-শাসন বিভাগ সব একাকার হয়ে গিয়ে একটি
অতিরাষ্ট্রের কথা! আবার যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের বেছে নেওয়া কিছু জায়গায় প্রতিষ্ঠান
কার্যত শূণ্য হয়ে গেছে গত কদিনে সেটাও আরেকটা কেন্দ্রাভিমুখী বিপজ্জনক অশনি সংকেত।
বাইরে থেকে রোপণ করা বা এনগ্র্যাফটেড আধুনিকতার যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সমস্ত
ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই।
লক্ষ্যণীয় যে যেখানে ইউরোপের একটি বড়ো অংশ প্রায় ৩০০ বছর
ধরে ধীরে ধীরে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, ভারতে তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েকটি
দশকে। ইউরোপীয়
দেশগুলোতে যেভাবে ব্যক্তির অভ্যুদয়, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি-নাগরিকের সহাবস্থান, সমাজ
বা কৌমের অবস্থান বিলুপ্ত হওয়া এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (সেক্যুলারিজম) পরিসর তৈরি হয়েছে ভারতে তা হয়নি। ভারতে
যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হলো সেগুলো মূলত
সমাজের উপরের স্তরের রাজনৈতিক ক্ষমতা-চিহ্ন, নীচের স্তরের সামাজিক ক্ষমতা নয়। আধুনিক
জাতি-রাষ্ট্রে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, রয়েছে নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস।
সামাজিক পরিসরের জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার রাষ্ট্রিক ভাষ্য
ছাড়াও আরও অনেক স্বর এবং কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-এর
দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক
Occupy Wall Street” বা
“Another World is Possible” আন্দোলনের কথা মনে পড়বে। এরকম একটি পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার, অ-নাগরিকের ধারণাও
সামাজিকভাবে মান্যতা, গ্রাহ্যতা পায়।
ভারতের
মতো ক্ষেত্রে যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় ভিন্ন প্রেক্ষিতে? রাজনৈতিক,
সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি হয়ে ওঠে কেন্দ্রাভিমুখী। ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেলো অন্তর্লীন গঠনগত বিরোধ।
অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে আধুনিক ভারত গড়ে ওঠার এক
অসামান্য আখ্যান সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই’। “অদ্ভুত
জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জৎ বাড়ে, বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের
ইজ্জৎ বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” “বোটের” সুতোয়
রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনো নাগরিক হয়ে উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়।
কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার এক আখ্যান। “বলান্টিয়ারদের”
দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর
কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” ঢোঁড়াইয়ের মননে বা সাইকি-তে যোগসূত্র তৈরি হল “মহাৎমাজীর”
সাথে – ইমাজিনড কমিউনিটিজ। এর
অবস্থান আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে। ঢোঁড়াইয়ের ভিন্ন যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক
ভারতের “পাক্কী” রাস্তার বাঁকে ঢোঁড়াই। কিন্তু
তার নাগরিকতার মধ্যে রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান।
১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে অনুসৃত ইউরোপীয় আধুনিকতার
ভাষ্যের উপাদানের মাঝে নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্রে
নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer (পূর্ণসংখ্যা)
হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশ অনুমোদিত নয়। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আলাদা
কিছু হয়না। ওগুলো ভগ্নাংশ, পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়। এরকম এক সামাজিক
মানসিকতা
তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা।
আবার পূর্ণসংখ্যা পজিটিভ হতে পারে। পূর্ণ
সংখ্যা নেতিবাচকও হতে পারে। গোরখপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ কাফিল খান – সরকারি
হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ না থাকার ফলে কতগুলো বাচ্চা স্রেফ মরে গেলো, বাইরে থেকে
অক্সিজেন জোগাড় করে ডাক্তারবাবু বাঁচালেন অনেকগুলো প্রাণ, তারপরে ৮ মাস জেল খাটলেন। এখানেও
তো আবার অন্য বিপদ আছে – আমাদের বিবশ
হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা আর ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। কিন্তু
নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা কখনো গৌরি লঙ্কেশ, কখনো কালবুর্গী, কখনো আখলাক, কখনো আসিফা,
কখনো পানেসার নামে নিঃশেষ হয়ে যায়। এসবের মাঝে অলক্ষ্যে নাগরিক পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে তার
সঙ্কোচন ঘটেছে, রাজনৈতিক চরিত্রের পৌরুষীকরণ হচ্ছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলো বিশেষ
সামাজিক প্রেক্ষিতে আপনমনে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম পাড়িয়েও দেওয়া হয়, যাকে বলে এথিকাল ট্র্যানকুইলাইজেশন।
কতসব অ-পূর্ণ রাশি!
নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দী-অহিন্দী, কেন্দ্রের
ভারত-প্রান্তের ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির
ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড-ডে
মিলের ভারত! সবাইকে প্রকাশ করতে হবে পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? কিংবা চিহ্ন-জ্ঞাপক
কোন শ্লোগান দিয়ে? রাষ্ট্র তো সে কথাই বলছে। হয় তুমি ভারতীয়, নয় তুমি ভারতীয় নও। আসাম
আজ শিখছে সেকথা, অন্য প্রদেশগুলোও হয়তো শিখবে ভবিষ্যতে। এর মাঝে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার নানা রকমের
কৃৎ-কৌশল রয়েছে, আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া।
হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে এগুলো নিজের নিয়মেই সহনীয়
হয়ে উঠবে।
শিক্ষকেরা
হয়ে যাবে educational managers, শিক্ষাদান সংক্রান্ত নানারকমের টেকনিক্যাল কাজকর্ম সামলাবেন। ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোন জ্ঞানভিক্ষু হিসেবে
অবস্থান তৈরি হবেনা। সিলেবাসও সেভাবে তৈরি হবে, যেমন সাম্প্রতিক দিল্লি বা
জওহারলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। নতুন সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে যার ভিত্তিতে রয়েছে শুধুমাত্র
তাৎক্ষণিকতা-নির্ভরতা, শুধুমাত্র বর্তমানকে যাপন করা। অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের লুম্পেনরা আলোয় আসার, রাজপথের দখল
নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে। স্পষ্ট ভাষায় ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করবে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেবে “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যায়। আমাদের
এতদিনের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছেনা। এখানে রাষ্ট্র শুধু
অতিরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে এমন নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই
ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীদের প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তা্দেরকেও তো
একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথকেও কোথাও কোথাও সিলেবাস
থেকে বাদ দেবার প্রস্তাব এসেছে। কর্পোরেট পুঁজির জগতে হয়তো তিনি বেমানান। ইতিহাসের পুনর্লিখন চলছে। ১৮৮৫
সালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করেছিলেন – “কুৎসিত বেশে সজ্জিত বর্বরতাপূর্ণ এই
বৈষয়িকতা মানবিকতার বিরুদ্ধে এক প্রবল অভিশাপ, কারণ পূর্ণতার শক্তির উপরে ক্ষমতার
প্রমত্ত আদর্শ চেপে বসেছে। … শক্তিমানের কাছে এই প্রলোভন যতটা সর্বনেশে,
দুর্বলের কাছে তা আরও বেশি ভয়ঙ্কর। … আমাদের জীবন হয়ে উঠুক বহিরঙ্গে
সহজ আর অন্তরঙ্গে মহীয়ান। আর্থিক শোষণ ও বিরোধের উপরে নয়, সামাজিক সহযোগের ভূমিতে
আমাদের সভ্যতা দৃঢ়ভিত্তি লাভ করুক।” (ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ)
নতুন করে সার্বিক কণ্ঠরোধের প্রসঙ্গ
উঠে আসছে বারংবার। কার কণ্ঠরোধ? ব্যক্তির? সমাজের? সমষ্টির? গোষ্ঠীর? সমাজ
কণ্ঠরোধ করছে কোন একক ব্যক্তির? সামাজিক গোষ্ঠীর? পরিব্যাপ্ত মানুষ
সমাজের? কিংবা এমন এক পরিবেশ, সামাজিক আবহ রচিত হচ্ছে যেখানে কোন শক্তিশালী কণ্ঠের
স্বরে অবশ্রুত হয়ে যাচ্ছে দুর্বলতর স্বর? কিংবা যেখানে কম গুরুত্বপূর্ণ
ঘটনার“ম্যানুফ্যাকচার্ড প্রাবল্য” বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে আপেক্ষিক নীরবতার
পর্দার আড়ালে ঠেলে দেয়? ইয়ুভাল হারারি (Yuval Noah Harari) তাঁর Sapiensঃ A Brief
History of Humankind-এ বলছেন যে সহিষ্ণুতা সেপিয়েন্স মানুষের কোন ট্রেডমার্ক নয়
– “Tolerance
is not a Sapiens trademark. In modern times, a small difference in skin colour,
dialect or religion has been enough to prompt one group of Sapiens to set about
exterminating another group.” জীবনকে নিঃশেষ করে
দেবার এরকম মারণান্তক বাসনার একটি তুলনায় নরম প্রকাশ কণ্ঠরোধ। এ বর্ণালীর
আরেকপ্রান্তে আছে extermination. এদুয়ের মাঝে অসংখ্য রূপে অগণন চেহারা নিয়ে চলে
রুদ্ধতার নানা কাঠামোর নির্মাণ।
ইতিহাসের কোন বিশেষ ক্ষণে এসে ব্যক্তির কণ্ঠের
প্রসঙ্গ কি আলাদা গুরুত্ব পায়? কোন বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ব্যক্তির স্বর কি চাপা
পড়ে যায় কৌম কিংবা সমষ্টির কণ্ঠের আড়ালে? রাজনৈতিক ইতিহাসের কোন বাঁকে এসে
ব্যক্তির উন্মেষের “discrete identity” একটি “concrete reality” হয়ে ওঠে? উনবিংশ শতাব্দীর
ইউরোপে – “আধুনিকতা” যখন মধ্যগগনে – তখন অন্তত দুটি বিষয় বৌদ্ধিক স্তরে আলোচ্য
বিষয়ের তালিকাভুক্ত হল। একদিকে “ঐতিহাসিকতা” এবং অন্যদিকে “রাজনৈতিক” হয়ে ওঠার
ধারণা। (দীপেশ চক্রবর্তী, প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ) প্রাক-পুঁজিবাদী কৃষি
অর্থনীতির সাথে জৈবিকভাবে যুক্ত কৃষক সিটিজেন বা “নাগরিক” হয়ে উঠলো। প্রশ্ন আসবে
এরা কি পূর্ণত “body politik”-এর সদস্য হয়ে গেলো? তাহলে কণ্ঠরোধের প্রসঙ্গটিও ভিন্নমাত্রা নিয়ে হাজির হবে।
পার্থ চ্যাটার্জী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন – “উচ্চবর্গের চেতনার স্বরূপ ও তার
নিজস্ব-বিবর্তনের ধারা ঐতিহাসিকদের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য। নিম্নবর্গের চেতনার
সন্ধান জানা যায় নানা জটিল বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধমে।” (পার্থ চ্যাটার্জী সং,
নিম্নবর্গের ইতিহাস) এবার উপনিবেশিক সমাজেও ব্যক্তিকে নিয়ে কিছু গোল বেঁধেছিল।
ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, “শিক্ষিত বাঙালি তার নিজের সমাজর মতামত সম্বন্ধে
নিরত্তাপ হয়ে ইংরাজরা কি বলল – নিন্দা করল না প্রশংসা করল – তাই নিয়ে মাথাব্যথা
করত।” (তপন রায়চৌধুরী, ইউরোপ পুনর্দর্শন)
যে জানলোনা “how one becomes what one
is”, জানলোনা
self-preservation কাকে বলে সেখানে কোন কণ্ঠ কি উচ্চারণেরজন্য পড়েথাকে? রুদ্ধতা যেখানে আজন্ম সেখানে
কণ্ঠরোধ শব্দটির অর্থই ভিন্নমাত্রা নেয়। আমরা যে কথাগুলো তৈরি করলাম আরেকজনের শ্রবণে পৌঁছে দেবার
জন্য, যে শব্দগুলো সত্তার গভীরতম বিন্দু থেকে উৎসারিত হল নভোমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ার
জন্য সেগুলো যদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসমাপ্ত অসম্পূর্ণ বারিকণার মতো জন্ম নিয়েই
শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায় তখনও তো আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয় – রুদ্ধতার, কণ্ঠরুদ্ধতার।
শরণ নিই শঙ্খ ঘোষের –
“কে তোমার কথা শোনে? তুমিই-বা শোন কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।”
যখন মনোজগতে বিচ্ছিন্ন, চরা পড়ে থাকা দারুচিনি
দ্বীপের মাঝে, নিস্পত্র বৃক্ষ, বর্ণহীন পুষ্প আর নিঃসার অস্তিত্বপুঞ্জ রাষ্ট্রের
সাথে সরাসরি কথা কইতে চায়? যদি “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে” দাঁড়ায়, যদি আরেকবার
বুঝতে চায় পল এল্যুয়ারের মতো –
“And by the power of a word I start my life
again
I was born to know you
To name your liberty”?
যদি সে হঠাৎ জেনে ওঠে “আদিম অন্ধকারের
মুখোস-দেবতা / তোমার একটিই আনন্দ / আমাদের মুখ ম্লান করে দেওয়া”? (বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, একটি অসমাপ্ত কবিতা)
প্রকৃতপক্ষে এরকম এক পরিস্থিতিকে বুঝতে চাইছি,
খানিকটা জলছবির মতো, খানিকটা লেখচিত্রের মতোও – “গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও
পাথর / হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর / তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে - / …. এ-দুই চোখে দেখতে দিন
বা না দিন / আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন / আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে” (শঙ্খ
ঘোষ, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ”)। কিন্তু রাষ্ট্রের এই বিপুল উৎসবের মাঝে যখন ভগ্নদূত schitz-এর মতো কেউ একজন হাত
তুলে বলে ওঠে “Ecce Homo – ঐ দ্যাখো মানুষ” তখন চরা পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মানুষগুলো আচমকা
বুকের বাঁদিকে পকেটের নীচে থাকা অত্যাশ্চর্য হৃদয়টিকে আবিষ্কার করে ফেলে। ঠিক সেই
মুহূর্তে একটি কবিতারও জন্ম হতে পারে –
দেখ, এই আমার স্বদেশ –
বন্ধুদের
হাতে হাত, ধমনীতে উষ্ণ রক্ত,
সময়ের
প্রসারিত রেখা ছুঁয়ে যায় বুক
করতলে বেড়ে ওঠে রৌদ্রের শিশুরা। (সব্যসাচী দেব, ‘সময়
বাহুতে বাঁধে প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’)
এরকম কবোষ্ণ কাব্যভাযাকে অতিক্রম করে আরেকটি
কাব্যভাষার জন্ম নেয় আমাদের বুকের বাঁদিকের সে অত্যাশ্চর্য দেহযন্ত্রটি থেকে –
“এলোমেলো হারিয়ে যাচ্ছ তুমি
লেগে আছে দাগ
মাটিতে ঘষটে নিয়ে যাওয়ার
এই দাগ ধুয়ে যায় না
আরও চেপে বসে
যতদিন না তুমি প্রশ্ন করছ
নিজেকেই
যতদিন না, তুমি ঘুরে দাঁড়াচ্ছ
নিজের বিরুদ্ধে।” (হিন্দোল ভট্টাচার্য, তৃতীয়
নয়নে জাগো)
যখন আকাশের দিকে তাকালে রক্ত আকাশ দেখি, মাটির
দিকে তাকালে তপ্ত মাটি আমাকে তর্জনী তুলে শাসায়, বাতাস যখন ভারী হয়ে থাকে কত লাশ
হয়ে যাওয়া গুম হয়ে যাওয়া দেহের কটু গন্ধে তখন আমাদের কাব্য আর কবির মাঝে ঢুকে পড়েন
স্টিভ বিকো লাশ হয়ে, মাত্র ৩১ বছর বয়সে।
কণ্ঠরোধ – কখন? কিভাবে? কেন? আরো আরো আরো? এখানে
কাম্যুর এক উপলব্ধি মনে পড়ে। ১৯৪৬-এর ১৯শে নভেম্বর লিখছেন – “The long dialogue
among men has just come to an end. Naturally, a man who will not listen is a
man to be feared. And so, along with those who have not spoken because they
thought it useless, a vast conspiracy of silence has spread among us, a
conspiracy sustained by those whose
interests reside in silence.” (Albert Camus, Between Hell and Reason, p. 118) চকিতে শঙ্খ ঘোষ আরেকবার
আমাদের স্মরণে চলে আসেন এরকম এক বাস্তবতার কাব্যিক ক্ষণে।
স্টিভ বিকোর (Steve Biko) কথায় আসি। ৩১ বছরের
তরতাজা যুবক বিকো, সাহিত্যসৃজনের সাথে জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। আরেকটি বড়ো অপরাধ
করেছিলেন – বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, আন্দোলন
সংগঠিত করছিলেন। সেজন্য পুলিস তাঁকে জেলবন্দী করে স্রেফ ঘুষি মেরে মাথা ফাটিয়ে
মেরে ফেলেছিল। একটি কণ্ঠ রোধ হল। কিন্তু সত্যিই কি হল? হলেতো আমার এ লেখায় তিনি
আসতেনই না। তাঁর বইও বিক্রী হতনা নামী পুস্তকবীপণি থেকে। কণ্ঠ প্রকৃতপক্ষে রুদ্ধ
হয়না। ওই লোরকার মতো – “বলেছিলুম কি না
কবির হাত শেকলে বাঁধা থাকবে না।”
এলেইন স্কারি তাঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ The Body in Pain-এ যন্ত্রণা এবং ব্যথা নির্দিষ্টভাবে কি করে বোঝাতে গিয়ে
বলছেন – “Physical pain does not simply resist language but actively destroys it,
bringing about an immediate reversion to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makes
before language is learned.” (p. 4) স্টিভ বিকোর মতো ইস্পাত-দৃঢ়
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাঙ্ম্য় অস্তিত্বকে “to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being
makesbefore language is learned”-এর স্তরে নিয়ে যেতে পারলে রাষ্ট্রের শক্তির একটি
নমুনা মেলে বৈকি। রাষ্ট্র আমাদের অস্তিত্বকে প্রাক-ভাষা (বা ভাষ, যে অর্থেই
ধরিনা কেন) পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম – এই বোধ উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও সেটা
রাষ্ট্রের বিজয়তিলক হিসেবেই গ্রাহ্য হবে। আমাদের আশ্বস্ত হবার অন্য কারণও
আছে।হার্ভার্ড এবং আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে cognitive neuroscience নিয়ে বিপুল উদ্যমে
গবেষণা ও চর্চা চলছে। এ গবেষণার একটি অভিমুখ হল যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ হার্ডকোর টেররিস্ট তারা দৈহিক এবং মানসিক অত্যাচারের ঠিক
কোন পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে (to the sounds and cries a
human being makes before language is learned) তার ব্রেইন ম্যাপিং করা এবং
মস্তিস্কের অ্যানাটমিতে কিরকম বায়োকেমিকাল পরিবর্তন হয় সেগুলোকে পরিমাপ করা।
দেহ-রাজনীতির এ অন্য এক অধ্যায়।
কণ্ঠ যখন কথা বলে তখন তার অভিঘাত কিভাবে এসে পড়ে
আরো দু-একটি উদাহরণ ইতিহাস ঘেঁটে দেখে নিই। চার্টিস্ট আন্দোলনের নেতা আর্নেস্ট
জোন্স। শ্রমিকদের সংগঠিত করছিলেন, মার্ক্সবাদের সাথে পরিচয় ছিল, এমনকি প্রভাবিতও
হয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ তখনো অনেক দূরের ব্যাপার। ১৮৪৮ সালের ৬-ই জুন একটি
জ্বালাময়ী, “রাষ্ট্রদ্রোহী” বক্তৃতা দিয়েছিলেন – “green flag of Chartism will soon be flying over
Downing Street.”সেসময়
সমগ্র পৃথিবীর অধিশ্বর ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কাছে এ কি কোন সহনযোগ্য বিষয় হল? জোন্স
চালান হলেন জেলের ১৩ ফুট বাই ৬ ফুটের একটি অন্ধকার খুপরিতে। তিনি কবি। কোন কাগজ
কলমও তাঁকে দেওয়া হতনা। নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে প্রথম দুটি লাইন সৃষ্টি
করেছিলেন তাঁর মাস্টারপিস কাব্যগ্রন্থ The Revolt of Hindostan-এ। তিনি লিখলেন –
In part by force, but more by panic driven.
Victorious deluge! from a hundred heights
Rolls the fierce torrent of a people's rights,
And Sepoy soldiers, waking, band by band,
At last remember they've a fatherland!
Then flies the huxtering judge, the pandering
peer,
The English pauper, grown a nabob here!
Victorious deluge! from a hundred heights
Rolls the fierce torrent of a people's rights,
And Sepoy soldiers, waking, band by band,
At last remember they've a fatherland!
Then flies the huxtering judge, the pandering
peer,
The English pauper, grown a nabob here!
লিখলেন –
A mighty shadow, deep, and stern, and still.
Threw o'er the fleet and flood each Indian hill;
The encampment's flag just reached the rising light,
Like lingering glory of the evening's fight:
One hour its last farewell majestic waved
Old England's pride, unchallenged and unbraved;
But a soft wind at sunrise, like God's hand,
Quietly bent it homeward from that land!—
Sad wound the weary numbers to the sea,
The signal's up, and Hindostan is free!
Threw o'er the fleet and flood each Indian hill;
The encampment's flag just reached the rising light,
Like lingering glory of the evening's fight:
One hour its last farewell majestic waved
Old England's pride, unchallenged and unbraved;
But a soft wind at sunrise, like God's hand,
Quietly bent it homeward from that land!—
Sad wound the weary numbers to the sea,
The signal's up, and Hindostan is free!
সাগরপারের একজন অবরুদ্ধ কিন্তু অনবদমিত কবি ও
সংগ্রামী রুদ্ধকণ্ঠ উপনিবেশের মানুষকে জানিয়ে দিলেন – তুমি মুক্ত হবে। জানিয়ে
দিলেন ইংরেজ ভিখারিরা ভারতে এসে নবাব বনে যায় (The
English pauper, grown a nabob here)। কি তীব্র শ্লেষ!
কি তীক্ষ্ণ ও মরমী ভালোবাসা মানুষের জন্য! মনে রাখতে ১৮৪৮ সালে লেখা এ কবিতার ৯
বছর পরে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল।
রাষ্ট্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শেলী লিখলেন England in 1819। রাজতন্ত্র, রাজপরিবা এবং এদের স্তাবকদের জন্য ঘৃণা
ও বিদ্রুপের কি সম্ভার সাজিয়ে দিলেন কবি! ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র-গণতন্ত্র
কবাডি খেলার প্রধান দুই দল টোরি আর হুইগদের নিয়ে লিখলেন অবিস্মরণীয় Similes For Two Political Characters
of 1819।
লিখলেন –
As
from an ancestral oak
Two
empty ravens sound their clarion,
Yell
by yell, and croak by croak,
When
they scent the noonday smoke
Of
fresh human carrion:--
শুধু এটুকু নয়।
কবিতাটি শেষ হচ্ছে –
Are
ye, two vultures sick for battle,
Two
scorpions under one wet stone,
Two
bloodless wolves whose dry throats rattle,
Two
crows perched on the murrained cattle,
Two
vipers tangled into one.
১৮৩৫ সালে লেখা একটা প্রবন্ধ/বই-এর উদাহরণ আমাদের কাছে আছে
– A Journal of Forty-Eight Hours of the Year 1945। লেখক হিন্দু কলেজের ছাত্র কৈলাশ চন্দ্র ঘোষ। প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল Calcutta
Literary Gazette (or, Journal of Belles Letters, Science, and Arts)-এ (vol. III, new
series, number 75, June 6, 1835)। দীর্ঘ
কাহিনীতে না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায় এ গল্পের নায়ক ২৫ বছরের যুবক ভুবনমোহন এবং তার
দুজন বিশ্বস্ত সাথী হল গঙ্গানারায়ণ এবং পার্বতীচরণ। এ গল্পের সময় ভাইসরয়ের নামও
তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেওয়া হয়েছে Lord Fell
Butcher এবং তার সামরিক জেনারেলের নাম John Blood-Thirsty।
হিন্দু কলেজের হোস্টেলে (১৯৪৫-এ নামকরণ হয়ে গেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যদিও ১৮৩৫-এ
লেখা বলে কৈলাশচন্দ্র ঘোষ এ নাম জানতেন না) এক অসম যুদ্ধের কাহিনীর বর্ণনা আছে। কর্নেল
ভাইসরয়কে ২৫ জন গোরা সৈন্যের মৃত্যু ও ২৫ জনের আহত হবার সংবাদ দিচ্ছে। কিন্তু
দেশপ্রেমিক বিদ্রোহীরা মারা গেছে ৬ জন, ১৩ জন আহত। যুদ্ধ শুরু হবার আগে ভুবনমোহন
ইংরেজ প্রতিনিধিকে স্পষ্ট স্বরে, নিরুদ্ধ কণ্ঠে জানায় – “Worthy Magistrate, I am sorry we are not able to
comply with your proposition; we defy you to do your worst. You see before you
men who will neither be terrified by the neighing of a steed, the waving of a
sword nor the flashing of a gun. We are determined to assert our liberties,
when every other resource has failed, by the strength of our arms. Go tell them
that sent thee that we have resolved to hurl Fell Butcher from his seat, we
have renounced the allegiance of the feeble and false Harry of England, and
that we mean to abide by our own laws and parliaments!”
আমাদের এসময়ে শেলী এবং
জোন্সের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই!
শেষ অবধি অসম স্বাধীনতার
যুদ্ধে ভুবনমোহন ও তার বাহিনী হেরে যায়। আক্ষরিক অর্থে যূপকাষ্ঠে তাকে প্রাণ দিতে
হয়। তাকে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাবার মূহূর্তে তার শেষ কথাগুলো ছিল – “আমার সহযোদ্ধা এবং
দেশবাসী! জন্মভূমির বুকে মৃত্যু হবার সান্ত্বনা বহন করছি আমি। আর যদিও বধ্যভূমিতে
আমার জীবন দেওয়াই ছিল ঈশ্বরের অভিপ্রায়, সহযোদ্ধাদের উপস্থিতি আমার শেষ
মুহূর্তগুলোকে আনন্দোচ্ছল করে তুলেছে। দেশরক্ষার জন্য আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু
আমি ঢেলেছি এবং যদিও এখন সেই ক্ষণ সমাগত যে আমার ভঙ্গুর দেহকাঠামোর মধ্যেকার
দুর্বল জীবন-স্ফুলিঙ্গ আমাকে ছেড়ে চলে যাবার মুখে, আমার আশা যে গৌরবোজ্জ্বল পথের
সূচনা তোমরা করেছ সে পথেই তোমরা হাঁটবে।” ভাইসরয় এরকম বীরত্বের সঙ্গে পূর্বপরিচিত
ছিলনা, যেমন নগ্ন দ্রৌপদীর উপচে পড়া তেজ দেখতে একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা
“সেনানায়ক”। এভাবেই সময়ের বদল হলেও কিছু কাঠামো আর উপাদান হাজারো সংস্কারের পরেও
একরকমই রয়ে যায়। যাহোক, “While
he (ভুবনমোহন)
was going on in this
strain, the viceroy struck with awe at the energy of the young patriot,
dispatched an officer to conclude the scene immediately.” নিরুদ্ধ কণ্ঠের এই অবারিত
দার্ঢ্য বহন করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য, “His hands were powerfully arrested, his head
forcibly thrust between two wooden pillars and severed from his body at a
single blow.” (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা
দরকার, ভারতে ১৮৫৭ পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসীতে ঝোলানোর
ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার খুব আগ্রহী ছিলোনা, বিশেষ করে ১৮৩৫ সালে
তো নয়ই। এখানে লেখকের মাথায় ফ্রান্সের গিলোটিনের ছবি কাজ করেছে বলে মনে হয়।)
ভারতের ইংরেজি শিক্ষায়
শিক্ষিত সমাজের কাছে সিপাহী বিদ্রোহ খানিকটা “লিটমাস টেস্ট” ছিলোতো বটেই। হিন্দু
প্যাট্রিয়টের বিখ্যাত সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জী বিদ্রোহীদের ”হৃদয়হীন” বলে গালি
দিয়েছেন। সিপাহী বা নিম্নবর্গের কণ্ঠ প্রাধান্যকারী ভাষ্যে জায়গা পায়নি। “পদ্মিনী
উপাখ্যান”-এ রঙ্গলাল লিখলেন –
ইংরেজের কৃপাবলে মানস উদয়াচলে
জ্ঞানভানু প্রভায় প্রচার।
হে বিভো করুণাময় বিদ্রোহ বারিদচয়
আর যেন বিষ না
বরিষে।।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
পরম-কারুণিক ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন –
হে নাথ করুণাময় নিবেদন তাই
তবপদে ইংরাজের জয়ভিক্ষা চাই।
এই মত রক্ষা করো তব অধিকার
ভারতে বিভ্রাট যেন
নাহি ঘটে আর।।
এর থেকে ভিন্নধর্মী ভাষ্যও
জন্ম নিয়েছে একই সময়ে গ্রামীন জনসমাজে –
রাজা হল নিশান (ঈশান) বাবু,
কালসাপ জমিদার।
গোলাপপুরের জমিদারের লুটলো
বাড়ীঘর।।
……………
শুনে হয় শঙ্কিত বিদ্রোহের
ফটাং কত।
অস্থির হল জমিদার আর তালুকদার
যত।।
(তথ্যসূত্রঃ জয়ন্ত
ভট্টাচার্য, “বিক্ষুব্ধ সময় – নিস্তরঙ্গ সংস্কৃতি”, সাগ্নিক সংকলন, ১৯৯১)
১৮৭০ সাল নাগাদ এক পল্লীকবি
কলকাতা বেড়াতে এসে সাধারণ লোকের অর্থকষ্ট দেখে মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে সম্বোধন করে
লেখেন –
পেটভরে পাই না খেতে
কাজ কি পথে,
কলের জলে, কাজ কি গ্যাসে?
করভার মুক্ত কর সয় না আর।
(সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, উনিশ
শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, পৃঃ ৩১৪)
কিন্তু সমাজের নীচের স্তরের এসমস্ত আবেগ,
প্রক্ষোভ, অনুভূতি, প্রতিবাদ, নিবেদন ওপরের স্তরের মূল ভাষ্যে কোন জায়গা নিতে
সক্ষম হয়নি। সমাজ যে body-politik এবং technique দিয়ে (ফুকোর ভাষ্যকে
অনুসরণ করছি) চলে তার মাঝেই এর অন্তত আংশিক উত্তর আছে। আধুনিক রাষ্ট্রের
সূচনালগ্নে, যেমন ফুকো আমাদের দেখান, দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনে যেন ”Man-the-Machine”-এর স্ক্রিপ্টটি লেখা
হয়েছিল। স্ক্রিপ্টের একদিকে ছিলো “anatomico-metaphysical register”, আরেকদিকে “technico-political
register” যা তৈরি করেছিল “a whole set of regulations and by empirical and
calculated methods relating to the army, the school and the hospital, for
controlling or coercing the operations of the body.” (Discipline and Punish, p. 136) পরবর্তী সময়ে ফুকো আরো বিস্তারে বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা করেছেন – “’Government’ did not refer only to political
structures or to the management of states; rather, it designated the way in
which the conduct of individuals or of groups might be directed: the government
of children, of souls, of communities, of families, of the sick. … To govern,
in this sense, is to structure the
possible field of action of others.” (“The
Subject and Power”, 1982) এই যে অন্যের
কর্মভূমির বিচরণক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার মাঝে governmentality-র
সার্থকতা এখানেই বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠের উদ্ভব ও অন্য কণ্ঠের লুপ্ত ও সুপ্ত হয়ে
থাকার মেকানিজম কাজ করে। যদিও আমাদের ভাবতে হবে এটা একরৈখিক কোন যাত্রা নয়।
একটি
অমোঘ সত্য জানান দেবেশ রায় – “যে-কেন্দ্রকে ভাঙতে চেয়েছি – সাম্রাজ্যের,
পেষণের, ক্ষমতার, শোষণের – সেই কেন্দ্রই আমরা গড়ে তুলেছি, দেশজুড়ে, আমাদের
কল্পনা-মনন জুড়ে, আমাদের চেতনা জুড়ে। কোথায় গেল আমাদের মুক্তির আলোময় পরিধি,
লবণাম্বুরাশির আভাচিক্কণ বেলাভূমি, অয়শ্চক্রনিভ দিগন্তময় দেশ, পর্বত যেখানে দেবতাত্মাআর
গ্রাম-জনপদ যেখানে কেন্দ্রিকতা-নিরপেক্ষ এক-এক স্বাধীন কেন্দ্র। কেন্দ্রিকতা
উদাসীন এক-এক স্বাধীন কেন্দ্র। এমনকি কেন্দ্রিকতা-বিরোধীও বটে।” (ব্যক্তিগত ও গোপন
সব ফ্যাসিবাদ নিয়ে একটি বই, পৃঃ ১০৮)
মহাশ্বেতা
দেবীর “স্তনদায়িনী” গল্পটিতে একবার প্রবেশ করা যাক। যশোদা হল প্রফেশানে মা। “নিজের
স্তন দুটিকে বড়ো মহার্ঘ মনে হল তার। রাতে কাঙালীচরণ খুনসুড়ি করতে এলে সে বলল,
‘দেখ! এখন এর জোরে সংসার টানব। বুঝে শুনে ব্যবহার করবে।’ … গিন্নিমা কি
তেরটা বিয়োয়নি? গাছের কি ফল ধরতে কষ্ট হয়?”
যশোদার
স্তন তার সত্তা, তার agency, তার অস্তিত্ব, তার স্বর, তার জীবন্ত জাগতিক প্রকাশ, এমনকি
তার নিরুচ্চার কণ্ঠ হয়ে ওঠে। এরপরে ক্যানসার-আক্রান্ত যশোদার স্তন? “ওর জন্যেই এত
আকুলি-বিকুলি ছিল? – সেই মনমাতানো বুকের এই পরিণাম? হোঃ! মানবদেহ কিসসু নয়। তার
তরে যে পাগল হয় সেও পাগল।” যশোদার ক্ষেত্রে ঈশ্বরত্ব-প্রাপ্তি কঠিন শ্লেষ আর
বিদ্রূপ হয়ে বাজে – “এ সংসারে মানুষ ঈশ্বর সেজে বসলে তাকে সকলে ত্যাগ করে এবং সততা
একলা মরতে হয়।” যশোদার মৃত্যুও ঈশ্বরের মৃত্যু।
শক্তি
চট্টোপাধ্যায় “ঋত্বিক, তোমার জন্য” পদ্যে উচ্চারণ করেছিলেন –
তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে
পোড়া
পাথরের মতো পড়ে আছো বাংলাদেশে, পাশে
ঋত্বিক,
তোমার জন্য তুচ্ছ কবি আর্তনাদ করে।।
স্পর্ধিত
প্রকাশ ক্রম-অপসৃয়মান। আমরা সবাই খণ্ড মানুষ, স্পর্ধাহীন অ-সাহসী মানুষ। কিন্তু
অনেকগুলো মানুষ জুড়ে গেলে? রুদ্ধ কণ্ঠ কথা বলতে পারে। নেরুদার মতো হয়তো বা বলে
উঠতেও পারে এই মনুষ্যপুঞ্জ –
And you will
ask: why doesn’t his poetry
speak of dreams and leaves
and the great volcanoes of his native land?
Come and see the blood in the streets.
Come and see
the blood in the streets.
Come and see the blood
in the streets!
speak of dreams and leaves
and the great volcanoes of his native land?
Come and see the blood in the streets.
Come and see
the blood in the streets.
Come and see the blood
in the streets!
No comments:
Post a Comment