Wednesday, December 25, 2019

সম্পাদকীয়







হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ্ধে, এন পি আর-এর বিরুদ্ধে। বর্তমানে ভারতের শাসনে যে দল এবং যে ব্যক্তিগুলি রয়েছেন, তাঁরা ও তাঁদের দল ভারতবর্ষে আনতে চলেছে হিন্দুরাষ্ট্র। আমরা সেই হিন্দুরাষ্ট্রের বাসিন্দা হতে ঘৃণা বোধ করি। এই হিন্দুরাষ্ট্র আমাদের দেশ নয়। এই হিন্দুরাষ্ট্রে কাগজপত্র থাকলেও আমরা বিদেশি-ই।

এ কথাও স্পষ্ট ভাবে বলার সময় এসেছে, যে, যে দেশে আমি জন্মালাম, যে দেশের মাটিতে জন্মানো শস্য থেকে খাদ্যগ্রহণ করলাম, যে দেশের জল খেলাম, সেই দেশের আকাশ জল ও মাটির কাছে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণপত্র দেখানোর অর্থ হল প্রধানমন্ত্রীকে বলা তাঁর মায়ের কাছে গিয়ে নিজের বার্থ সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলা যে এই যে আমি তোমার সন্তান, তার প্রমাণ।

নিজের দেশ তো নিজের মায়ের মতোই স্বাভাবিক। এ দেশের জল, হাওয়া, মাটির  সঙ্গে, গাছের সঙ্গে, শস্যের সঙ্গে, আমাদের সম্পর্ক মায়ের সঙ্গে সন্তানের মতো। এ নাড়ি ছেঁড়ে না। জিনের মধ্যে থাকে। ঠিক দেশের সীমান্তরেখা দিয়ে এই সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা যায় না বলেই ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশের আকাশে হেলিকপ্টারে করে যেতে যেতে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন। এটি বোঝার ক্ষমতা সম্ভবত উগ্র দেশপ্রেমিকদের থাকেনা, কারণ তাঁরা ভালোভাসেন তাঁদের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে, দেশের সঙ্গে বন্ধন ঠিক কোথায়, তা জানার জন্য নয়।

এ কথা স্পষ্ট ভাবে বলার সময় এসেছে, যে আমাদের আর হিন্দু-মুসলমান-মন্দির-মসজিদ দিয়ে ভাগ করা যাবে না। আমাদের রুটি চাই, একজন কৃষক যাতে আত্মহত্যা না করেন, তার নিশ্চয়তা চাই,  আগুন বাজার যাতে মানুষের নাগালের মধ্যে আসে, তার ব্যবস্থা চাই, স্কুল চাই, কলেজ চাও, স্বাস্থ্যপরিষেবা চাই সমগ্র দেশে। আম্বানি চাইনা, আদানি চাই না, শপিং মলের ভিড় চাই না, কর্পোরেটদের হাতে দেশকে বেচে দিতে চাই না, উন্নয়নের নামে উগ্র দেশপ্রেম আর উগ্র দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে স্টেশন-শহরের নামবদল থেকে মন্দির তৈরি চাই না, ধর্মের নামে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ চাই না।

উত্তরপ্রদেশে যে নির্বিচারে গণহত্যা করছে, প্রতিশোধের রাজনীতি করছে যোগীর পুলিশ, আমরা তার বিচার চাই। নাগরিক পঞ্জীর নাম করে সারা দেশে আগুন জ্বালিয়েছে এই রাষ্ট্র। আমরা এই রাষ্ট্রের এই ভূমিকার বিরোধিতা করি। এই রাষ্ট্র, যার প্রধামন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গৃহমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ, আমরা এমনিতেই সেই রাষ্ট্রের কাছে বিদেশি। কারণ আমরা তাঁদের কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ হয়ে থাকতে পারব না। আমরা পারব না ইতিহাস বিকৃত করতে, নিজেদের সংস্কৃতিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে।

আমাদের চোখের সামনে নাগরিক পঞ্জী করে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করে এ দেশে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প করার ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার বিরুদ্ধে যতক্ষণ পর্যন্ত বিরোধিতা করার বিরোধিতা করব। এর জন্য আমাদের জন্য আমাদের শুনতেব হয় আমরা দেশবিরোধী, তবে, অবশ্যই, আমরা সেই দেশের বিরোধী, যে দেশে রাজ করে ফ্যাসিস্ট শাসন।

আমরা বরং সেই দেশের নাগরিক, যে দেশ নিজেদের প্রাণভয় তুচ্ছ করে দলবদ্ধ ভাবে এই ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের কোনও মানচিত্র নেই। এই দেশের মানুষ আছে। এই দেশের কোনও কাঁটাতার নেই, কিন্তু এই দেশের রয়েছে মানববন্ধন।

আমরা হিন্দুরাষ্ট্র ভারতবর্ষের বাসিন্দা হতে ঘৃণা বোধ করি।

লাল সেলাম জানাই সেই ভারতবর্ষকে, যে রুখে দাঁড়িয়েছে হিন্দুরাষ্ট্র ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে।




সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ হিন্দোল ভট্টাচার্য মণিশংকর  বিশ্বাস  শমীক ঘোষ সন্দীপন চক্রবর্তী


গৌতম বসু






মৎলেব কাকা

মৎলেব কাকার পুরো নামটা বাবার কাছ থেকে আমার জানা হয় নি। বাবার তুলনায় ওঁর  গায়ের রঙ ছিল বেশ ফর্সা ; আমার চোখে উনি খুব লম্বা, সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে প’ড়ে পথ চলতেন। বাবার সহকর্মী উনি ছিলেন না, আবকারী বিভাগে কাজ করতেন। শুনেছি, কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গে থাকা্র  সময় থেকে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে পরিচয় হয়, যা মৎলেব কাকার মৃত্যু পর্যন্ত অক্ষত ছিল। আমি যখন জগৎসংসার সম্পর্কে ধাপে-ধাপে সব জেনে ফেলছি, তখন বাবার জীবনে স্মৃতিচারণার বয়স এগিয়ে আসছে, বাবা গর্বসহকারে বলত, তখনকার দার্জিলিঙের গোটা এক্সাইজ় বিভাগে সম্ভবত মৎলেব-ই ছিল একমাত্র সৎ অফিসার! বর্দ্ধমান জেলার কোথাও-একটা মৎলেব কাকাদের গ্রামের বাড়ি, সেখানেও আমরা দুদিনের ছুটি কাটিয়ে এসেছি । আমার ওপর রাগ ক’রে মা পরে জ্যাঠাইমাকে বলেছিল, এত অসভ্য ছেলে, মেজদিদিভাই, ওঁদের সামনে আমি মুখ দেখাতে পারলাম না, পুরোটা সময় মুরগির পেছনে ছুটে-ছুটে কাটাল!
     ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, কোন অকারণে কে জানে, দাঙ্গা বাঁধল কলকাতায় । ইস্কুল খোলার পর ফিরে এসে দেখি, মৌলালির মোড়ের মস্‌জিদের রাস্তার দিকের দেওয়ালটা কালো হয়ে গেছে । একটু কালো আগেই ছিল ধোঁয়ায়, কারণ ওটা ছিল মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখবার জায়গা, সেজ্‌দা দেবার জায়গা । এই কালো অন্যরকমের কালো । এ-নিয়ে বাবাকে আমি কোনও প্রশ্ন করি নি, কারণ ততদিনে জগৎসংসার সম্পর্কে আমি আরও অনেক জেনে ফেলেছি । এর পরে  একদিন, বাবা, মা আর আমি আবার গেলাম মৎলেব কাকাদের বাড়ি । মা ভেতরের ঘরে চ’লে  যাবার পর মৎলেব কাকা বললেন বাবাকে, কড়েয়া থানার লাগোয়া এই বাড়িটা ভাড়া নিলাম, বুঝলেন । ওনার শরীর ভাল থাকে না, ছেলে মেয়েরাও বুঝতে শিখছে; আগে থেকে ভেবে রেখেছি, এবার কিছু হলে, সপরিবারে লক-আপে ঢুকে ব’সে থাকব। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, মিষ্টান্নের রেকাব হাতে, বাবা মাথা নীচু ক’রে ব’সে আছে । আমার দিকে ফিরে মৎলেব কাকা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমাদের স্কুলের কাছে ওই মস্‌জিদ কি ওভাবেই প’ড়ে আছে? কেউ আবার রঙ করে নি? প্রথমে আমি সংক্ষেপে বললাম, হ্যাঁ । তারপর মাথা নেড়ে বললাম, না । জগৎসংসার-বিষয়ে অভিজ্ঞ, আমিও বাবার মতো মিষ্টান্নের রেকাব হাতে মাথা নীচু ক’রে ব’সে রইলাম ।                         

সন্মাত্রানন্দ






শব্দের জমায়েত
   
লেখার খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে দেখছি, শব্দের রাজপথে আজ ক্রমশই জমে উঠেছে দ্রিংচড়কের উৎসব। মাঠ জুড়ে  শব্দেরা হরেকরকম বিভক্তির সাজপোশাক পরে নেমে পড়েছে। কেউ দ্বিতীয়ার ‘কে’, কেউ ষষ্ঠীর ‘র’, কেউ  সপ্তমীর ‘ে’, কেউ বা একেবারেই নিরলংকৃত শূন্য। কয়েকটি পৃথুল ক্রিয়াবিশেষণ পিছিয়ে পড়েছিল,তারা এসে  পৌঁছুল পরে গদাইলশকরি চালে। মিছিল ধরে দাঁড়িয়েছে সবাই,চেঁচিয়ে বলছে,ক্রিয়াপদ...ক্রিয়াপদ যেন  লাইনে সবার শেষে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়াল এসে সবার আগে ক্রিয়া তাদের ওই কথা শোনামাত্রই,হাতে তার উড্ডীন  প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন। কয়েকটি ব্যঞ্জনাময় অলঙ্কৃত মেয়েশব্দ হিহিহি করে হেসে ওই দেখে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল। আর দুয়েকটি যুবাশব্দ চিবুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল অনম্র প্রতিজ্ঞায়। তাদের হাতে হাত রেখে বলিষ্ঠ  কোমল দাঁড়িয়েছে রুশতী নারীশব্দ কতগুলি সঙ্গীতমুখর। এদেরই মাঝে মাঝে ছুটে ছুটে অনেক  ‘ও’, ‘কিন্তু’,  ‘এবং’, ‘বরং’, ‘অপিচ’ ‘মিছিলের পদযাত্রীদের সঙ্গে ক্রমাগত সংযোগ রক্ষা করে চলেছে।  
ব্যাপার হচ্ছে,শব্দের ধর্ম নিয়ে,জাত নিয়ে প্রবল আন্দোলন উপস্থিত। এমন ঘটনা বা রটনা যে,তৎসম ব্রাহ্মণ শব্দগুলিই নাকি থাকবে লেখায়,টিকে যাবে ম্লেচ্ছ ইংরেজি শব্দসমূহও আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সুপবিত্র স্মৃতি হিসেবে। পর্তুগিজ বা ওলন্দাজ শব্দ,প্রাকৃত বা পালি শব্দ আবেদন জানালে তাদের শরণার্থী হিসেবে মেনে নিয়ে পরে নাগরিক করে নেওয়া হবে। দেশি শব্দদের নাকি মেনে নেওয়া হয়েছে আগেই,যদিও  তাদের প্রতি নাসিকাকুঞ্চনের ভাব একেবারে যায়নি। কে আবার কবে কোলভিল চাষাভুষা মুচিমুদ্দফরাসের ভাষাকে সম্মান করে! প্রয়োজনে লাগলে প্রান্তিকবর্গ মানুষের সাহিত্যে ওদের নির্বাচন করে নেওয়া যাবে।        
মুশকিল হয়েছে আরবি আর ফারসি শব্দগুলো নিয়ে। ওদের নাকি কোনো আবেদন করতে দেওয়া হবে না। ভাষাসদস্য হবার ন্যূনতম আবেদনটুকুও করতে হবে না ওদের। এবং এইভাবেই তারা পূর্বাহ্নেই চিহ্নিত হয়ে গেলে অন্তিমে তাদের কোথাও ডিটেইনশন ক্যাম্পে তালাবন্ধ করে রাখা হবে কিংবা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ভাষামাঠের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। আরে, শেষ অবধি তো আরবি শব্দ,ফারসি শব্দ—এরা কোথাও থেকে প্রতাড়িত হয়ে এই ভাষামাঠে ঢুকে পড়েনি। ওরা জন্মেছে আক্রমণকারী খাজাঞ্জা খাঁ-র খামখেয়ালের সন্তান হিসেবে। ওদের এখন তাড়িয়ে বের করে দেওয়াই ভালো, নয়ত ডিটেইনশন ক্যাম্পে কিছুদিন রেখে টুঁটি চেপে মেরে ফেললেই চুকে গেল ঝামেলা।   
তবে সবাইকেই প্রস্তুত রাখতে হবে কাগজপত্র, জমির পড়চা, জন্মের রসিদ আর বাপঠাকুরদার ঠিকুজি, কুলুজি এবং প্রয়োজন হলে দেখাতে হবে নিপীড়িত, ধর্ষিত হবার ফোটোগ্রাফ, ফরেনসিক রিপোর্ট, রক্ত-বীর্য-অশ্রুর শুকিয়ে যাওয়া দাগ। এসব না হলে ‘শরণার্থী’ খেতাব মিলবে কেমন করে?     
এই পরিকল্পনায় অন্তিমে শুধু তৎসম শব্দই থাকবে,ভাষা হয়ে উঠবে একটি তৎসমরাষ্ট্র। তৎ এখানে রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং লেখক। তিনি কাকে রাখবেন, কাকে ফেলবেন—সবই তাঁর রাজধর্মনিষ্ঠ মেজাজ ও মর্জি।   
এমন বিভেদদৃষ্টির মতলব আগাম বুঝতে পেরে সমস্ত শব্দরাই আজ লেখার খাতায় মিছিল করে দাঁড়িয়েছে, এমনকি উচ্চবর্ণের তৎসমরা এসেছে,হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে পালি,প্রাকৃত,মাগধী,অর্ধমাগধী,দেশি, বিদেশি,যাবনিক সবাই। তাদের মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত শ্লোগান তুলছে ভাষাদেশে সকলে মিলেমিশে একসঙ্গে বাস করার সমান অধিকারে। ওরা গান গাইছে,বিশৃঙ্খল চেঁচিয়ে উঠছে,শ্লোগান দিচ্ছে,দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে স্বৈরাচারী লেখকের বিরুদ্ধে সোচ্চার সমষ্টিগত প্রতিবাদে।

নীলাঞ্জন হাজরা








সুড়ঙ্গ

আমার ধমনীতে দৌড়ন

রক্তের গতি

আমি কোনও দিনই মাপিনি
কিন্তু শাহজাদা সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত
এই দুঃস্বপ্নে যে,
আমি নির্ঘাত একদিন আমার ধমনীতে ছুটে আসা

রক্তের সামনে

তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব
এবং তিনি ভীষণ রক্তাক্ত হবেন
শাহজাদা তাঁর জংলি স্মৃতিতে বিলক্ষণ জানেন তীব্র

রক্তের গন্ধ

চারপাশ থেকে কাদের ডেকে আনে
ধূর্ত শিকারী শাহজাদা
এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে কেঁপে কেঁপে উঠছেন যে
তাঁর প্রিয় মৃগয়া-জঙ্গলে সহসা তিনি রক্তাক্ত একা

চারপাশ থেকে ছুটে আসছে
আমার ধমনীতে নিঃশব্দে দৌড়ন

ক্রুদ্ধ রক্ত


চৈতালী চট্টোপাধ্যায়





কাহিনী

এবং সুখের ভাত যারা
দুঃখ করে খেয়েছে,তারা
গুছিয়ে ঘুমোতে গেছে...
হঠাৎ চমকে উঠে বসে।
আগুন গড়িয়ে চলে এসে
ছুঁইছুঁই পালঙ্ককিনারা!
ওরা জানতো নিরুপদ্রব
নিজে,আর নিজের আয়না।
প্রতিবেশীরাও তো অজানা!
তখন আতঙ্ক ছুটে এলো।
ধস নামছে, খুশবু মরছে,
ঘোমটা-পরানো অন্ধকার।
যাপনে,রান্নায় মধু ছিল,
ফিকে নীল বিষে থরোথর!
কেউ হাত টেনে নিয়ে গেল,
কেউ চোখ দূরে ছুঁড়ে দিল,
কাঁটাতার দিগন্তে বসালো,
ওরা কল্পনাতেও আনেনি -
রাষ্ট্র চাইলে সবই হয়!
এখনও যে জ্যান্ত রেখেছে,
এটা কি অবাককাণ্ড নয়?

বেবী সাউ






তুমি কে হে শাসক ভালোবাসার ওপর 
রক্ত ঢেলে দেওয়ার?



আমাদের দেশের বাড়ির উত্তরে বেড়া দেওয়া; তখনও উঁচু পাঁচিল ওঠেনি। আর বেড়ার ওপারে একটা শত্রুজাত সংসার।  আমার দোদণ্ডপ্রতাপ দাদু সেই শত্রুদের উপর কিছুতেই নিজের অধিকার ফলাতে পারছিলেন না, আর ওরাও কিছুতেই মানতে পারছিলেন না দাদুর শ্রেষ্ঠতা। স্বাভাবিকভাবেই দ্বন্দ্ব এসে পড়ে। আর তার ফলভোগ করি আমরা, বাদবাকি জীবেরা। যাদের নিজস্ব কোনও মত নেই, অধিকার নেই এমনকি পদ নেই।  দাদু নিজস্ব মেজাজে
সমস্ত পরিবারের ওপর চাবুক ঘুরিয়ে চলেন, আমরা অসহায় প্রানীকুল সেই ছড়ি র গতি প্রকৃতি অনুসারে জীবনযাত্রা সাজাই। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করি। সুতরাং,  ওই বাড়ির কৎবেল, আমড়া কিংবা বাতাবিলেবু কখনও আমাদের আর খাওয়া হলো না। মা-কাকীমারা বেড়ার এপাশ থেকে অতি সন্তর্পণে কিছু কিছু কথা চালান করতে পারতেন যদি দাদু যেতেন পেনশনের টাকা তুলতে কিংবা অন্য কোনও কাজে।  যাইহোক,  এইযে আমাদের বাড়ি, আমাদের সাম্রাজ্য যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার দাদু। আর আমরা ছিলাম তাঁর ঋণগ্রস্থ প্রজা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি, সারাবাড়ি থমথম করছে। দাদু মুখ ভার করে বসে আছেন সদর ঘরে। ঠাকুমা গলায় আঁচল জড়িয়ে একমনে মালা জপ করছেন একমনে। হঠাৎ এরকম একটা পরিস্থিতিতে ঢুকলে যা হয়...মায়ের কাছে জানলাম, আমার কুলাঙ্গার(দাদুর মতে) জেঠু ওই বাড়ির অসুস্থ  ঠাকুমাকে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালে। আর তাতে এই। রাতে জেঠু ফিরলে, বিরাট কিছু হবে ভেবে আমাদের ভাইবোনদের তাড়াতাড়ি ডিনার করিয়ে দেওয়া হল। কেউ আমাদের আর পড়াশোনা করার জন্য চাপও দিল না। সমস্ত বাড়ি যেন একটা গুমোটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর আমরা নিশ্বাস নিচ্ছি এমন ভাবে যাতে শব্দ না হয়।

তো,  তখন রাত ন'টা হবে বোধহয়।  জেঠু এলো।  হাত-পা ধুয়ে গামছায় মুছছে। "বৌদি কেমন আছেন?" লে!শেষে দাদু? দাদুই পালটে গেলেন!  কোথায় গেল রাগ? কোথায় গেল আইডেন্টিটি? কোথায় গেল যাবতীয় রুলস?  রীতি?  আসলে এতদিন যা ছিল রুলস, রেগুলেশন তাকেই আমরা অনিবার্য মেনে এসেছি। তাকেই আমরা রাষ্ট্র ভেবে এসেছি। কিন্তু যখনই কেউ এসে বললো আমি এই নিয়ম মানি না, এই যুক্তি মানি না তখনই নত হয় নিয়ম, শাসক এবং তার শাসন।

সত্য আমরা সবাই জানি। এই মানচিত্র, এই দেশ, এই রাষ্ট্র,  শাসক এবং শাসন আসলে সবই ক্ষণস্থায়ী এবং ভঙ্গুর। বারবার মানচিত্র পালটায়, দেশ পালটায়,  শাসক, শাসন পালটায় কিন্তু পালটানোর জন্য জাগতে হয়, উঠে দাঁড়াতে হয় সেই  আপাত নিরীহ,  অসহায় মানুষকেই। আজ যদি আমাকে প্রণাম করতে হয় আমিই আমি! আমার কথাগুলো আমার,  আমার লেখাগুলো আমার, আমার বলা, চিন্তা, ভাবনা,  যুক্তি -- এসব আমার! আর সেটা প্রমাণ করতে হবে শাসকের মতো করে? যে শাসক অত্যাচার করতে পারাটাকে বিজয় মনে করে, উল্লসিত হয়? সামান্য কাগজের দাম আছে কিন্তু একটা জীবনের দাম নেই? সামান্য মাটির দাম আছে কিন্তু 'মা'-এর দাম নেই?

আজ যদি আমার মা'কে,  যে আমার জন্মদাত্রী আর আমাদের এই ১০০০স্কোয়ার ফিট বাড়ির মালিক, হিসেব মতো তিনিই আমার সবকিছুর মালিক, এমনকি আমার জন্মেরও, তাকে যদি সবসময় আমার বার্থ সারর্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় "এই দেখো, এই আমার জন্মতারিখ, আমি কি বাথরুমে যাবো? " "এই দেখো, আমার বার্থ সার্টিফিকেট আমি কি তোমার রান্না খেতে পারি?" --- ব্যাপারটা যেমন হাস্যকর তেমনি অসম্ভবও বটে।

আবার যদি উল্টোটা ধরে বলি, ধরুন আমাদের পাড়াতুতো কেউ এসে বললেন " কই তোমার বার্থ সার্টিফিকেট দেখি? সত্য সত্যিই তুমি তোমার মায়ের মেয়ে কি না?" তখনই কি আমি তেড়ে গিয়ে বলবো না, "তুই কে রে?" আর এসব জায়গায় কাগজপত্র কতটুকু ভূমিকা গ্রহণ করে?

আমি আমাদের গ্রামে দেখেছি অধিকাংশ মানুষের কোনও কাগজপত্র ঠিকঠাক নেই। কিন্তু কত কত পুরুষ ধরে তারা এই মাটিকে,  জমিকে, আমাদের ছোট্ট খালটিকে, বৃদ্ধ বটগাছটিকে ভালোবেসেছেন। শ্রদ্ধা করেছেন। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ঐতিহ্য,  সংস্কৃতি।  দুঃখে কেঁদেছেন, আনন্দে ভেসেছেন --- আর এখন যদি বলা হয় এইযে তোমরা নদীকে, নালাকে, আনন্দকে, দুঃখকে ভালোবেসেছ তার প্রমাণ দাও! কাগজপত্র দেখাও--- সেটা কী সম্ভব? 

গ্রামে, আমি দেখেছি বিয়ে হয় অগ্নিকে সাক্ষী মেনে, কোনও কালো কোট পরা অপরিচিত উকিলকে মেনে নয়। আমি দেখেছি, বাচ্চার জন্মসাল মনে রাখা হয় মন্বন্তর কিংবা বন্যাকে সাক্ষী মেনে। আমি জানি আমার দেশের অধিকাংশ কৃষক ফসল ফলান যে জমিতে সেই জমির কোনও কাগজপত্র তার কাছে ফাইলবন্দি হয়ে গুছানো নেই। শুধু মুখের কথা এবং ভালোবাসার সূত্রে বছরের পর বছর তারা জমি থেকে, বুকের ঘাম পায়ে ফেলে দু' মুঠো অন্ন জোগাচ্ছেন রাষ্ট্রের মুখে।

তুমি কে হে রাষ্ট্র,  এসবের কাগজ পত্র খোঁজার? তুমি কে হে শাসক ভালোবাসার ওপর রক্ত ঢেলে দেওয়ার?  তুমি কে হে দেশ সীমারেখা নির্বাচন করার? তুমি কে হে শাসন মাটি থেকে,  ভূমি থেকে উচ্ছেদ পর্ব শুরু করার?

যে শাসক নিজেই আমাদের করের টাকায় খায়,  বিদেশ ভ্রমণ করে, দামী দামী স্যুট বুট পরে, বর্ষা- গ্রীষ্ম-শীতের পরিশ্রম করা ফসলে মোচ্ছব করে--- সে বলে শাসনের আইন? দেশপ্রেমের কথা? সে বলে কাগজ পত্রের কথা?

কে দিল তোমাকে এ অধিকার রাষ্ট্র? মানুষ,  মানুষ আর মানুষ... যারা অতি সাধারণ,  অতি অতি অতি সাধারণ --- তারাই...

কুশান গুপ্ত






তিনটি কবিতা

ক্ষুধা

শেখোনি পবিত্র হতে মন্ত্রপুত জলে।
সম্মতি-স্বভাব শেখো, হে বাচাল, অতি বেঁড়েপাকা,
প্রয়োজনে হতে হয় হেঁটমাথা, প্রয়োজনে যথোচিত মৌন।                                                            জাতীয় সঙ্কট এলে ব্যক্তিগত চুম্বনেও লিখে দিতে হয় দেশগাথা

সীমান্তে যখন যুদ্ধ, ক্ষুধার প্রসঙ্গ, জেনো, বড়বেশী বেমানান, গৌণ।

তখন বারুদের গন্ধ মনে হয়
শুধু গুগগুল, ধুপধুনা।
তখন মিডিয়া ফোঁকে অহরহ কুরুক্ষেত্র-শিঙা।
জাতীয়-হৃদয় জুড়ে
বেজে চলে পরিত্রাহী কুচকাওয়াজ, ঘোড়-সমারোহ।
তখন সম্রাট বলে প্রতিভাত হয় শুধু বানিয়া-দালাল।
তখন সনাক্ত করা হয়
কেবল তোমাকে, আমাকে...
যেহেতু, ক্ষুধার কথা বলি।





তারপর, হারানিধি

সমূহ গ্লাসের তুমি তদারকি করো আজ,
আমি শুধু গাই...

আমি ততক্ষণ গাই মনে মনে মাধবী-মধুপে
তারপর কী যে লিখি হারানিধি
:
অথচ অ্যাজেন্ডা আছে নানাবিধ, সামাজিক দায় বড় দায়
;
বিশেষত রাজ্যপাল এ-বিষয়ে, মাননীয়, বলেছেন...
সেই সাংবিধানিক পরামর্শ মানি, এসো, ফোকটে বয়কট করি যথাক্রমে কাশ্মীর ও কন্যা কুমারী কা,
 
এবং দু-ঢোক গিলি, অতঃপর,
বিধিমত ধুঁয়াধার রজনী মানাই।

তার আর পর নেই, হারানিধি, তুমি ঢালো, আর আমি খাই...






 গল্প

সেইস গল্পগুলি আমিও শুনেছি, কোথাও যা লেখা ছিল না।
সেইসব গল্পেই বিবৃত ছিল কবরস্থ সভ্যতার পিতল-পিলসুজ, আর
আদিম গুহাকরোটির অনির্দিষ্ট ঠিকানা...
জেনেছিলাম কীভাবে আবিষ্কৃত হয় ঘুমন্ত দ্বীপ
আর রক্তস্নাত সোনালী ভূখন্ড।
চিরায়ত সেইসব গল্পেই
গভীর জলের নীচে অনায়াসে ঘুমিয়ে থাকত কৃষ্ণভ্রমর,
জেগে থাকত অলীক রূপো-রঙা মাছ।

সামান্য হাসির, আর, অনেক কান্নার গল্প ক্লান্তিহীন শুনে গেছি তোমাদের কাছে।
শুনেছি বন্যা ও মন্বন্তরের রুদ্ধশ্বাস কাহিনীগুলি কতদিন
তোমাদেরই মাটির দাওয়ায় বসে।

শুনেছি, একটা গ্রামে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের কাছে আছে একটা দীর্ঘ ক্যানেল...
তার একদিকে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানো দুরন্ত একচক্ষু দানব ও তার দলবল,
অন্যদিকে তীর-ধনুক
হাতে কালো একগাদা অর্ধনগ্ন মানুষ...
শুনেছি, সেই কালো মানুষের দলে আমার পিতাও নাকি ছিল।
শুনেছি, মুহুর্মুহু গুলির শব্দের পাশাপাশি
নাকি শাঁখও বেজেছিল একদিন সেই গ্রামে।
গল্পই, তবু
একদিন কীভাবে আমি দেখে ফেলেছিলাম একটা ক্যানেলের ধারে,
একটা অযত্নে পড়ে থাকা রংচটা শাদা শহীদের বেদী,
যার গলা অবধি ঢেকে রেখেছে চতুর্দিকের আগাছা আর এক মানুষ ঘাস,

আর কিছু ভাসন্ত কাশফুল।



তন্ময় ধর




অনাগরিক

১।
আমার কাছে সূর্যোদয়ের কাগজপত্র চাওয়া হয় একদিন
মুন্ডহীন এক সাপের দেহবোধ স্থির হয়ে থাকে আমার সামনে
তরল কোষপ্রাচীরে আটকে থাকা অন্ধকারে
তর্জনীর শব্দের পাশে এসে দাঁড়ায় একটা ছায়া

আলোর ওপর অগণন মাছের কঙ্কাল
মৃত নৌকায় রক্ত ও মাতৃদুগ্ধের দাগ
খিদের অর্থহীন ভূগোলে টোকা পড়ে
‘স্যর, একটু বাইরে আসবেন’

বুকের যন্ত্রণার সামান্য নীচে গুলিটা লেগেছিল
ওখান থেকে উড়ে গেল অজস্র মৎস্যভুক পাখি
কাগজপত্রে সই করতে করতে
আমি কামড় বসালাম পক্ষীমাংসে

২।
কাগজ ছিঁড়ে ফেলল প্রাচীন এক হাওয়া
নৌকার ধ্বংসাবশেষে ভিতর আমরা লুকিয়ে রইলাম
স্মৃতিহীন শামুক-ঝিনুকের বিছানায় আমাদের পাশে অঙ্ক করতে বসলেন মিলাঙ্কোভিচ
পৃথিবীর কক্ষপথ একটু একটু করে হেলতে থাকল আমাদের রক্তাক্ত রুটিতে

আমাদের অবেলার ঠান্ডা ভাতের পাশে নেরুদার আঙুল, চিলির সৈকতের মাইল মাইল অন্ধকার
ভিদেলার স্বৈরাচারী অশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার অতিকায় পিতামহ
নীল চোখের তারায়, ঘুমে ফিরে আসছে আমার মৃত সঙ্গীদের খিদে, ব্যথা, ছায়াচিৎকার
বৃত্তকার পাখির দল ফিরে যাচ্ছে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মরদেহের পাশ দিয়ে

বাস্তুজমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে কবেই, মৃগশিরা-ফসলের কাল, আলপথ
আদিম মানুষের কঙ্কাল খুঁড়তে খুঁড়তে আমি ও প্রপিতামহ ক্লান্ত হই
নাস্তিক পন্ডিতের ভিটার পাশ দিয়ে আমরা চুপচাপ হাঁটতে থাকি
বৃশ্চিক নক্ষত্রের দিকে

৩।
পোড়া কাগজের নীচে গান লিখছেন গিরীন চক্রবর্তী
কিশোরগঞ্জের মৃতদেহগুলির সাথে বড্ড মিল ছিল আমার আত্মীয়দের
শেষ মুহুর্তে দৌড়ে গোয়ালঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন মেসোমশাই-
‘অবলা জীবগুলি কেন মারা পড়বে?’

কম্পাসের সৌন্দর্য্যের নীচে পড়ে আছে দিগভ্রষ্ট মানুষের শীত
ধূসর কালিতে লেখা ধানরঙ শিশুর জন্মপঞ্জি, জ্যামিতি, জল, গর্ভফসল
কিছুই নেই, শূন্যতার ওপর জাল বোনে মেঠো মাকড়সার দল
ভোরের শিশির জমে জাল ভারী হয়
আমার অন্ধত্বের সামনে মাংসের ভিতর মাংস কাটছে একটা মুখ
একটা মুখোশ হিসেব করতে করতে আমাকে লুকিয়ে রাখছে মাংসের ভিতর
একটা হাওয়া আমার খিদের ঢাকনা সরিয়ে দিচ্ছে
আমার পিতামাতার জন্ম হচ্ছে কাঁটাতারের সবচেয়ে ধারালো অংশে

সুরঞ্জন রায়




রিটেনশান ভয়

খোলা ছাদের তলায়
আমাদের পরিচয় খুঁজে ফেরে পুরনো দলিল
রক্তের ভিতরে স্বপ্ন-ভোর
ক্রমশ দূরের পথে এগিয়েছে সাম্যবাদী
                             অসহিষ্ণু সকাল-বিকেল! 

খোলা আকাশের নীচে
মানবতা পাক খায় বিরুদ্ধ মায়ায়...
রাতারাতি মুছে যায় ভালোবাসা-নাগরিক ক্ষয়।

আমাদের পরিচয় খুঁজে ফেরে রক্ত চাটা
                                          রাষ্ট্রের দালাল !
ক্রমশ রাতের ঘণ্টা বেজে ওঠে, দু'চোখে ঘনায়
                                          রিটেনশান ভয়! 

                                    
.

অভীক মজুমদার





আমার স্বদেশ



আর্শি

সামনে বসিয়ে একটা আর্শি
বাবু বললেন, 'হোক এনার্সি!
কাগজপত্র কিছু নেই দেখে
গায়ে পরে নেন গেরুয়া জার্সি!


মানুষ

হবে এনার্সি হবেই তো ক্যা
বললো মোটা বললো ন্যাকা

একটা হাঁদা বলছে হেঁকে
'ছাত্র পেটাও গুন্ডা ডেকে

খুনিগুলোর বুদ্ধি দেখে
লালন বলে,' পাপের দলে ভেসে ভেসে
জুটলো দেশে
এ কোত্থেকে
মানুষ ব'লে আদৌ কি আর ডাকবো একে'?



মিছিল

যদি ভাবো  বন্দুকে
দিতে পারো গতি রুখে--
ভুল!
যদি ভাবো বন্দুকে
গুলি ছুঁড়ে বুকে বুকে
সহজে ভুলিয়ে দেবে
দেশ মাটি গান

ভোলাবে ভোলাবে শ্যাম ভোলাবে আজান

তবে তুমি, হে দানব
আগাগোড়া গর্দভ
মাথামোটা, হাবা বিলকুল!




মাটি

মাটি, আমার স্বদেশভূমি
কোন ক্ষমতায় কাড়বে তুমি
বলতে পারো?
ধর্ম-জাতি সব একাকার
উড়িয়ে দেব ঘনান্ধকার
যতই মারো!
ফ্যাসিস্টগুলো লুকিয়ে আছে
পাড়ায়-পাড়ায় নানান ঠেক-এ
ফেসবুকে আর মেসেঞ্জারে, কয়েকটা, হ্যাঁ, পদ্য লেখে!
দাঙ্গা-খুনের কেতন ওড়ায়, ঘেন্না শেখায়, অসভ্যতাও
ওদের জন্য তেরঙ্গা আর সংবিধানের সূর্য ওঠাও...


রবি ঠাকুর

জিতে গেলেন, আপনি, রবি ঠাকুর
সারা ভারত জুড়ে দেখুন পড়ুয়াদের মিছিল থেকে
উঠছে কেবল একই কথা, যুগে-যুগের উদার বাণী
অহরহ যে আহ্বানে লক্ষ-হাজার আস্থা রেখে
ভাঙছে দেওয়াল সর্বনাশের, ভাঙছে রাজার যা শয়তানি

কাঁদছি হাসছি ওদের সঙ্গে, বলছি, তোরা খুব বাহাদুর
বুঝতে পারছি বুড়ো হলাম, ওদের নিশান ঝড়,রোদ্দুর
জিতে গেলেন, ওদের জোরে, আপনি একা রবি ঠাকুর!

দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়






সময়ের লেখা

আর কতবার এভাবে পুড়ব? আর কতবার মরি?
কত কতবার বলেছি, এস না, এই পৃথিবীটা গড়ি
ধর্ম কী, বলো? কোথায় সে থাকে? কোন দেশ তার, জানো?
দেশের গল্পে রাষ্ট্র থাকে না, হিন্দু, মুসলমানও

বিভেদকামীরা ফিরে ফিরে আসে, আগুনে ঝাঁপায় পাখি
মানুষের হাতে, বিপন্নতায়, হাতখানি যেন রাখি
দামাল হাওয়ায়, মিছিলে, স্লোগানে, প্রতিরোধে, তরজায়
ফ্যাসিস্ট বোঝে না ওদের নিয়তি ইতিহাস রেখে যায়!

Tuesday, December 24, 2019

পৌলমী গুহ






নৈরাজ্য এবং


কাঁটাতার দেখিনি আমি। আমি সুখী।
দু'বেলার ভাতে অপার শান্তি আছে।
নাটক, নভেল, চর্বিত চর্বণ আছে।
আমি অতএব সুখী।

একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখছি,
কঙ্কালের স্তুপ জমেছে রাস্তায়।
সুখী হতে চেষ্টা করি তাও। চেষ্টা,
টের পাই শিরদাঁড়া অসমান আমার।

রাষ্ট্র তখন মানুষ খুনে ব্যস্ত।


উঠোনের যেদিকে তুলসীতলায় মা প্রদীপ জ্বালাতো,
শুনলাম, ওটা আমার দেশ নয়।
বাবা যে চায়ের দোকানের নিত্য খরিদ্দার ছিলো,
শুনলাম, সেটাও।
স্টেশন, বাজার, খেলার মাঠ, যা "আমাদের" বলে চিনতাম,
শুনেছি সেসবও নয়।

বাবা এখন বাক্সে আলমারিতে দেশ খুঁ‌জে ফেরে।
মা আর তুলসীতলায় যায় না।


বন্ধুর মুখ অন্ধকারে চেনা যায় না।
হাতঘড়ির কাঁটা রাত্রে গড়ালে ভয় হয়,
এই বুঝি রাষ্ট্রের পরোয়ানা থাবা বসালো।
বন্ধু বলেছে এতোদিন ভুল ছিলো।
ঠিকটুকু বুঝতে কোনোও পতাকা খুঁজছে ও।
ওর মুখ আলোতে চিনতে পারি না আর!


টিভিতে সং-রা আস্ফালন করে।
কাগজে যতো মুখের ছবি,
তার মতো আহত করে না কেউই।
চলে যেতে হবে মেনে নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরি।
শুধু কিছু মুখ এখনও প্রজাপতি বোঝে।

অমর মিত্র






দেশজুড়ে শীত

কনকনে শীত ধেয়ে এসেছিল বছরখানেক ধরে। কেন ? আমরা তো পূর্ববঙ্গের মানুষ। তখন খুলনা জেলা সাতক্ষী্রা  মহকুমা। তা এখন সাতক্ষীরা জেলা হয়ে গেছে। বসিরহাট শহর থেকে মাইল কুড়ি দূরে সেই সাতক্ষীরে। সাতক্ষীরে থেকে ৫ মাইল দূরে আমাদের গ্রাম ধূলিহর। বেতনা নদী সেই গ্রামের ধারে। কপোতাক্ষ কিছুটা দূরে বুধাহাটা পেরিয়ে বড়দলে। মায়ের কাছে শুনেছি বড়দলে স্টিমারঘাটা ছিল। আমার মামার বাড়ি বাঁকা-ভবানীপুর গ্রাম কপোতাক্ষর ধারে। মামার বাড়িও একেবারে কপোতাক্ষর.২৫০ মিটার দূরে হবে। আমি ২০১৬ সালের ৬-ই নভেম্বর  মামার বাড়ি প্রথম দেখি। কপোতাক্ষ মজে গেছে। স্টিমার কেন তালডোঙাও চলে না এখন।  

১৯৪৭-এর ১৪-ই আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নিল দ্বিজাতিতত্বের সূত্র ধরে। তখন আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু শুনেছি, তখন খুলনা জেলা পাকিস্তানের ভিতরে ছিল না। হিন্দু অধ্যুষিত খুলনা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৮-ই আগস্ট খুলনা চলে যায় পাকিস্তানে, মুর্শিদাবাদ চলে আসে ভারতে। মুর্শিদাবাদ ছিল মুসলমান অধ্যুষিত জেলা। কিন্তু মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে গেলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যেত। আমার বাবা তৎকালীন অবিভক্ত দেশে  বাংলা সরকারে চাকরি করতেন। দেশভাগের সময় অপশন দিতে বলা হয় সরকারি কর্মচারীদের। বাবা ভারত সরকারে  অপশন দিয়েছিলেন। এবং বহরমপুরে সীমান্ত উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের  দায়িত্বে ছিলেন।  উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ করতে করতে তাঁর বদলি হয় ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন অফিসে লিয়াজ অফিসার হিশেবে। ১৯৫০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরিতে জয়েন করেন। কারণ এপারে আমাদের ঠাঁই ঠিক করতে হবে তো। বসিরহাট সংলগ্ন গ্রাম দণ্ডীরহাটে ১৯৫০ সালে জমি কিনে বাড়ি করা হয়। সেই আমাদের পাকাবাড়ি হলো। সেই বাড়ি ছিল বাবাদের তিন ভাইয়ের নামে। ৮৯ শতক জমি। এইটুকু জানা ছিল।  বাবা কলকাতায় চাকরি করতেন রাইটার্স বিল্ডিঙে, তার আগে ঘাটাল এবং কাঁথি ঘুরে এসেছেন। আমাদের ভাড়াবাড়ি   বেলেঘাটা হয়ে বেলগাছিয়ায় ১৯৫৪-৫৫ সাল থেকে। এখনো সেখানে আমি থাকি। আমাদের যে অংশ দণ্ডীরহাট গ্রামের বাড়িতে, তা রয়েছে। শুধু সেখানে গ্রামের এক দুস্থ জামাইকে  থাকতে দিয়েছিলেন বাবা। তিনি এখনো আছেন। এমনিই ভোগ করেন। আমরা যাই না। বাবার ভূসম্পত্তিতে আসক্তি ছিল না। আমাদেরও আছে বলে মনে হয় না। সেই বাড়িতে কতদিন যাইনি। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর ধাক্কায় আমি দণ্ডীরহাটের বাড়ির দলিল খুঁজতে থাকি। ঘুম উড়ে যায়। আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ ঠিক করে যেতে হবে তো।  সেই জমির দলিল হারিয়ে গেছে। দাগ নম্বর জানি না। কী দিয়ে পর্চা কিংবা দলিল বের করব?  দুই কাকা তাঁদের অংশ হস্তান্তর করে চলে এসেছেন দণ্ডীরহাট থেকে। খুড়তুতো ভাইদের কাছে কিছু নেই।  আমি যুগন্ধর পত্রিকার  স্বরূপ মণ্ডলের মাধ্যমে যেভাবে হোক জমির দাগ নম্বরগুলি পাই। স্বরূপের বাড়ি দণ্ডীরহাট গ্রামে। দাগ নম্বর ধরে   রিভিশন্যাল সেটেলমেন্টের পর্চা বের করতে পারি বসিরহাট বি এল এল আর ও-র অফিস থেকে। স্ক্যান করা সরকারের শিলমোহর সম্বলিত পর্চা দেখে বুঝতে পারি বাংলা সন ১৩৫৭, অর্থাৎ ইংরেজি সন ১৯৫০ থেকে বাবাদের তিন ভাইয়ের নামে রায়ত দখলীস্ব্ত্বের অধিকার  দেওয়া আছে। আমি জমি বুঝি। এই দপ্তরে চাকরি করেছি, ফলে নাগরিকত্বর প্রমাণ  কী হতে পারে আমাদের, সেই নথি  সম্পর্কে আমার  একটা ধারণা ছিল। কিন্তু নাগরিকপঞ্জীতে নাকি ভারত সরকার ১৯৪৮ সালের ১৯শে জুলাই একটা তারিখের সীমা করেছেন, এমন কথা শুনেছি অনেকবার। ফেসবুকে তা লেখা হয়েছে অনেকবার। তারপরে যারা এসেছে তারা সব শরণার্থী। এখনো শরণার্থী। তাদের আবেদন করতে হবে নাগরিকত্বর জন্য। মুসলমান বাদ। মুসলমানের নথি দিয়ে এই দেশে বসবাসের অতীত ইতিহাস দেখাতে না পারলে ঘ্যাচাং।  অনুপ্রবেশকারী। অদ্ভুত আইন। হিন্দু  আবেদন করলে সরকার বিচার করে নাগরিকত্ব দেবে। এত বছর থেকে, নিজের দেশ নিয়ে গর্ব করে এই অবস্থা। আবেদন করতে হবে? করে নিজেকে শরণার্থী বলে ঘোষণা করতে হবে। হা ভগবান।  পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সব মিথ্যে। এগুলি কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা কেন ? 

   এইসব শুনে  আমি  বাবার চাকরির নথিপত্র খুঁজতে আরম্ভ করি। বাড়িতে কিছুই নেই। মৃত্যুর আগে বাবা মা থাকতেন সল্টলেকে দাদার বাড়িতে। সেখানে কিছুই গুছোন নেই। পেনশন বই নেই। পাশবই নেই। ১৯৭২ সালে বাবা অবসর নিয়েছিলেন। আমার ৮১  এবং ৭২ বছরের দুই দাদা মনোজ এবং উদয়ন আমাকে ফোন করতে লাগলেন বারবার, কী হবে?  আমি পর্চা হাতে পেলে আশ্বস্ত হয়েও বারবার জিজ্ঞেস করছেন হবে তো রে।  স্ক্যান করা পর্চা মানবে তো ? তুই যা করার কর। বাবার চাকরির সময় নিয়ে তিন ভাইয়ে কথা হতে থাকে। ঠিক পারটিশনের সময় বাবা ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার কালিহাতিতে। বাবা ঋণশালিশী বোর্ডের আধিকারিক ছিলেন। ঋণগ্রস্ত চাষীদের ঋণ মকুব করে বেড়াতেন। বড়দা, মেজদা তখন ছোট। আমি খুঁজতে লাগলাম বাবার চাকরির নথি। দিল্লিতে লেখক  সৌরাংশু  সিংহ থাকেন। ভারত সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি। অসম্ভব ভালোবাসেন আমাকে। তাঁকে ফোন করেছি। সব বলেছি। যাঁরা ভারত সরকারে অপশন দিয়েছিলেন সরকারি কর্মচারী তাঁদের বিষয়ে কি তখন  গেজেট নোটিফিকেশন হয়নি। বাবা যে ভারতীয় হাইকমিশন ঢাকায় ১৯৪৮-৪৯ কিংবা ৪৭-এ লিয়াজ অফিসার   ছিলেন, সেই তথ্য কি গেজেটে থাকবে না ? থাকার কথা। সৌরাংশু বলল থাকার কথা। জাতীয় মহাফেজখানায় খোঁজ করবে। আমার ৮০ বছরের দাদার প্রতিদিন ফোন, কী কোনো খবর এল ? খবর আসেনি।  বড়দা বলছেন, আমার স্কুল ফাইনাল সারটিফিকেটটা পাচ্ছি না। বি, এ পাশ ১৯৫৯ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে। দ্যাখ পরশু দিন স্কুল ফাইনাল সার্টিফিকেট দেখলাম, এখন পাচ্ছি না, কোথায় যে রাখলাম? তুই বাবার চাকরির ডকুমেন্ট জোগাড় কর।  আমি তখন ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন প্রকাশিত সাহিত্যপত্র ভারত বিচিত্রার  সম্পাদক নান্টু রায়কে বলি হোয়াটসআপে। কল করে বলি সেখানে কি নেই রেজিস্টার ? নান্টু বলেন নেই। শ্রীনিবাসন নামে এক হাইকমিশনার ছিলেন, পুরোন নথি পুড়িয়ে দিয়েছেন অনেক। আর হাইকমিশনের বাড়ি বদলেও কিছু গেছে। বুঝুন শ্রীনিবাসন পুড়িয়ে দিয়েছেন। পুড়িয়ে দিয়ে আমাদের সব্বোনাশ করে গেছেন।
  
  মনোজ মিত্র সারা ভারতেই পরিচিত। আমিও কিছুটা পরিচিত। সমস্তজীবন এই দেশ আমার দেশ বলে ভেবেছি। ধ্রুবপুত্র উপন্যাস লিখেছি দূর মধ্যপ্রদেশে বারবার গিয়ে। উজ্জয়িনী তার পটভূমি।  নি্রূপায় মানুষের আতঙ্ক নিয়ে নিসর্গের শোকগাথা লিখেছি মহারাষ্ট্রের লাতুরে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সেখানে গিয়ে। মরাঠী গ্রামের মানুষ তাঁর মূল চরিত্র। ভারত আমার দেশ। গল্প লিখেছি বিহারের দলিত হত্যা নিয়ে। এসব কি ডকুমেন্ট হয় না আমি ভারতীয় কি না ? আমার চেয়ে আমাদের চেয়ে বেশি ভারতীয় কে ?    ভারত সরকারের  সাহিত্য অকাদেমি পেয়েছিলাম। আমাদের যদি এই উদ্বেগ হয়, সাধারণ মানুষের কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। কে কোন কাগজ রাখে বলুন। হাইকমিশনই তার পুরোন নথি পুড়িয়ে দেয়, রাখে না কিছুই তো সাধারণ মানুষ সাতপুরুষের কাগজ রাখবে ?  এই আতঙ্ক ভয়ানক। ৭০-৭৫ বছর একটা দেশের নাগরিক হয়ে থেকে এখন তার পরীক্ষা দিতে হবে? এই যে আধারের সঙ্গে মোবাইল নং জোড়া, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড জোড়া...এই করতে করতে ক্যা ( CAA ) আইন। এন আর সির কথা বলা সবই আতঙ্কের। আসামে ১৯ লক্ষ মানুষ এন আর সি ছুট। এই বাঙালি নাকি ঘুসপেটিয়া, উইপোকা ( মানবাত্মার কত অসম্মান ! )। অনুপ্রবেশকারী। মুসলমান কেন বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসবে ভিটে বাস্তু ছেড়ে তা আমি বুঝি না। যদিও আসে কাজের খোঁজে, তার সংখ্যা কত হতে পারে? এসেছে উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দু। আসামের এন আর সি ছুট ১৯ লক্ষের ভিতরে   কতজন ১৯৭১-এর পরে এদেশে এসেছেন আমি জানি না। কাগজপত্র দেখাতে পারেননি বহু যুগ এদেশে বাস করা উভয় ধর্মের মানুষ।  নিষ্ঠুর সরকারি কর্মচারী কলমের খোঁচায় তাদের নাগরিত্ব ঘুঁচিয়ে দিয়েছেন।  যিনি এন আর সি-র মূল দায়িত্বে ছিলেন, তিনি অসততার কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। নাম নথিভুক্ত করতে মানুষের হয়রানির শেষ হয়েছে। সেখানে অর্থের লেনদেনও নাকি হয়েছে। এ তো হয়েই থাকে। সরকারি কর্মচারীর বেশিরভাগ সৎ, কিছু অসৎ। অসৎ কর্মচারীর দাপটই বেশি দপ্তরে দপ্তরে। এন আর সি তো জীবন মরণ সমস্যা। সেখানে মানুষ এখান থেকে ওখানে ছোটাছুটি করে মরেছে কত।

এইটা জানি এদেশে বহু মানুষ ভূমিহীন। জমি থাকলেও পর্চা, দলিল বন্ধক দিয়ে চাল কিনে ভাতের ফুট দেখে  বাঁচে। দলিল, পর্চা সব জমা রাখে গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষের কাছে। রেখে তারই মজুর হয়। এসব দেখা। এই কারণেই নথিপত্র অমিল হয়। বহু মানুষের বাস্তুভিটে নেই। ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি আইন করেছিলেন যাঁরা অন্যের জমিতে, যেমন ধরুন পুকুরপাড়ে, পতিত জমিতে ঘর বেঁধে থাকেন তাদের বাস্তুজমি অধিগ্রহন আইন ১৯৭১-এ দু’কাঠা করে বাস্তু রেকর্ড করতে হবে। বিনয় চৌধুরী যখন ভূমি সংস্কার মন্ত্রী তিনি এই আইন করেছিলেন।  সেই আইনে শুনানি করে অনেক পরিবারেকে  নিজস্ব ভিটা দেওয়ার কাজ করেছি। এসব একাত্তর সালের পরে হয়েছে। এই বাস্তুহীন মানুষজন মূলত তথাকথিত  নিম্নবর্গের। বাউরি, বাগদি, ভুমিজ, এবং আদিবাসীও। আদিবাসীরা তাদের জমি হারিয়ে হারিয়ে ভূমিশূন্য হয়েছে এ আমি দেখেছি। ‘দানপত্র’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম ১৯৮০ সালে। একটি কথা ভাবতে হবে,  এই মাটির অধিকার তাদের সব চেয়ে বেশি। তারাই তাদের জমি হারিয়ে  ভূমিশূন্য হয়েছে। আমেরিকার নেটিভ,  মূল অধিবাসীরা, রেড ইন্ডিয়ান এবং অন্যান্য উপজাতিরা রাষ্ট্রপুঞ্জে একটি আবেদনপত্র জমা করেছিল, তার বিষয় ছিল ‘তাদের হারিয়ে যাওয়া মাটি, পাহাড়, অরণ্য, নদী, আকাশ বাতাস সব ফেরত পাওয়ার অধিকার’। তাদের মাটির উপরই তো ধনগর্বী দেশ আমেরিকা। এই ঘটনা এই দেশেও ঘটেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে  জমি বন্দোবস্ত পায় ধনী রাজপূত জোতদার রাসবিহারী সিং। আদিবাসী রাজা দোবরু পান্না সব জমির অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন আগেই।

 হে উচ্চবর্ণ,  তুমি কী  নথি দেখতে চাও?  তুমি দিকু। তুমিই বহিরাগত। যাদের মাটি তারাই উচ্ছেদ হবে? যত বড় বড় প্রকল্প হয়েছে এদেশে, তারাই ত্যাগ করেছে। অভিমন্যু মাহাত কবিতা লিখেছেন, তাঁদের তো মূর্তি পুজো নেই। তাঁরা পাহাড়, গাছ, গ্রাম দেবতির থানে মানত করেন। তাঁদের ধর্মে সবই লৌকিক আচার, উৎসব। টুসু ভাদু কোন ভগবান হিন্দু ধর্মে ?  ভারতবর্ষ এমনি তো ছিল। এর কী হবে ?  মানুষের কাছে নথি থাকে না। যে মানুষটি ১৯৪৭-এর আগে বরিশালে জন্মেছেন, তিনি অখণ্ড ভারতেই জন্মেছেন।  দেশটা  আতঙ্কের দেশ হয়ে গেল কয়েকবছরেই।
  
 অনুপ্রবেশকারী ধরতে পুলিশ, গোয়েন্দা যথেষ্ট। জেরা করলেই সত্যি কথা বলে দেয় সাধারণ মানুষ। তার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলা কেন ? নোট বাতিলের কথা মনে আছে। কী উদ্বেগ! ব্যাঙ্কের লাইনেই মারা গেছেন কতজন। ফলাফল শুনেছি শূন্য। কালো টাকা ঘরে আসেনি। হিশেবে বাজারে যে  টাকা ছিল, সেই টাকাই  ব্যাঙ্কে ফিরেছে। কালো টাকা গেল কোথায়? নাকি কালো টাকা আগেই শাদা হয়ে গিয়েছিল।  সেই টাকা না ফেরার কথাই তো ছিল।  আর এন আর সির আতংকে আত্মহত্যা করেছেন কতজন। কেন এই ভাবে মানুষের ভোটে জিতে মানবাত্মার অপমান ?  ধর্ম নিরপেক্ষ দেশটির জন্য কী গর্ব ছিল আমার। তা শেষ হয়ে যাবে ? ইসলামিক রাষ্ট্র আছে বলে হিন্দু রাষ্ট্র করতে হবে?  ওই রাষ্ট্র অন্ধকারে ডুবেছে বলে আমাদেরও ডুবতে হবে। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ক্রমশ আতঙ্কের রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ, হত্যা, সামরিক শাসন, ভারতের গৌরবজনক স্থান সেই রাষ্ট্রের নেই। বাংলাদেশে কতলক্ষ মানুষ মেরেছিল তারা!  ডিটেনশন ক্যাম্প! কী ভয়াবহ তার ধারণা। একেবারে নাৎসি ক্যাম্প যেন। এর বিপক্ষে সাধারণ মানুষ জেগেছে। ছিন্নমূল মানুষ  যাঁরা এদেশে এসেছেন তাদের নাগরিকতা দিন সোজা পথে। কেন ঘোষণা করবে তারা এখনো শরণার্থী। এত বছর বাস করে শরণার্থী হবে কেন? অধিকার আছে। দেশ আমরা ভাগ করিনি। রাজনৈতিক নেতারা ভাগ করেছেন।  অখন্ড ভারত আমার দেশ ছিল। ভাগ করলেন কেন ? আমরা তো চাইনি। বাঙালি ঘুসপেটিয়া ! বাঙালি এই ভারতের স্বাধীনতা এনেছে। বাঙালি  এই উদ্বেগের ভার কেন নেবে  ? এর ভিতরে ব্যাঙ্কের টাকা নিয়ে ভয় ঢুকেছে। জীবনদায়ী ওষুধের দাম পাঁচগুন হয়ে গেছে। এইটা কি সভ্য দেশ?  এক এন আর সি সমর্থক, হিন্দু রাষ্ট্রের সমর্থক  অতি সাধারণ এল আই সি এজেন্ট বলছিল আমাকে, ‘সুদ কমছে, কমবে, আমেরিকায় সুদ দেয় না ব্যাঙ্কে।’  হু দেয় না। খাদ্য বস্ত্র ওষুধ কত শস্তা  তা জানো ?  ওদের দশ টাকা মানে দশ ডলারে একদিনের খাদ্য হয়ে যায়।  সে খুব সমর্থক ছিল। একদিন এল শুকনো মুখে।  আমি বললাম কাগজপত্র রেডি কর। কীভাবে কী করবে বললাম।  ভয় ঢুকেছে তার ভিতরে। তাদের তো একাত্তরের আগের কাগজ কিছু নেই। বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া থেকেছে। এই কবছর আগে একটা শস্তার ফ্ল্যাট কিনতে পেরেছে। এপারে ১৯৭১-এর আগে পরে জন্ম হয়ত। কিন্তু তার জন্ম নিবন্ধন করা ছিল না। পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল হয়ে এসে বাবা ব্যবসা করতেন রেডিমেডের। জামা-কাপড়ের হকার। তার কোনো লাইসেন্স লাগত না। কী করবে ? বলুন কী করবে ? সরকার অভিভাবক। সেই সরকার যদি তার নাগরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, নাগরিকের পথে নামা ব্যতীত উপায় নেই।  অনুপ্রবেশ করলে বি এস এফ-এর উপর দায় চাপান। সব বন্ধ হয়ে যাবে। গোয়েন্দা লাগান, খুঁজে বের করা যাবে।  হায় আমার দেশ! তুমি কবে আমার স্বপ্নের দেশ হয়ে উঠবে। বসন্তদিনের দেশ। আতঙ্কের  যে শীত নেমেছে এই দেশে তার অবসান হোক।

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ