Tuesday, December 24, 2019

গুচ্ছকবিতা তৃষ্ণা বসাক





ভূমিহীন আগুন


এখন সেই মুহূর্ত উপস্থিত,
তুমি বললে রেডি?
আমি জল গায়ে কোনমতে শাড়িটা জড়িয়ে
বেরিয়ে এসেছি,
তাড়াহুড়োয়
আমার বাঁপায়ের কনিষ্ঠতম আঙুল লেগে
গড়িয়ে গেছে দুধ -
খানিকটা কাঁচা দুধ সরিয়ে রেখেছিলাম,
পাঁচটা আস্ত ফল, ডিভাইন আগরবাতি
আর নিষ্কালি সরা -
গাঁ বাঁধার জন্য গঙ্গাপণ্ডিত যেমন যেমন বলেছিল •••

আমার শরীর থেকে চুঁয়োনো জলে
কার্পেট ভিজে যাচ্ছে,
তুমি বললে রেডি?
এখন সেই মুহূর্ত উপস্থিত,
বাথটবে নীল হয়ে ভাসছে আমাদের শব,
সাদা কাপড়টা উড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়ছে
রামচেলা পাসোয়ানের ওপর নিচে শোয়ানো
তিন ছেলে, চার মেয়ে!
ওরা খুব বেশি জায়গা নেয়নি,
প্রথম দিন বাহাত্তর পয়েন্ট
পরের দিন অর্ধেক,
তার পরের দিন আরো••••

জেহানাবাদ থেকে
গ্রাহাম স্টেইনসের কবরের ঘাস থেকে
পোড়া বইয়ের ছাই থেকে
রাশি রাশি লাল পিপড়ে
সময়ের মতো অবিচ্ছিন্ন দংশনমালায়
আমাকে উশকে দিচ্ছে,
আমাকে কাঁচা দুধের
মোজেইক শুচিতা থেকে
ছুঁড়ে দিচ্ছে ভূমিহীন আগুনে ।



মান্টোকে নিবেদিত
ঠান্ডা মাংস


তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে
এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না ।
রাতের অন্ধকার একে চিরে চলে যাবে,
যেন কণ্ডোমবিহীন জিপ,
আর এ পড়ে থাকবে পারাপারহীন ফ্লাইওভারের মতো-
তোমার অশ্বারোহীর মতো পুরুষাঙ্গের নিচে
এ শহরকে আর আগের মতোন পাবে না ।

কমলালেবুর মতো স্তনদুটি, ঠান্ডা, 
যেন সদ্য ফ্রিজ থেকে বের করা,
রেশমবেড়ালের মতো যোনি, কাঠ,  এখনি মাছি বসবে,রোদ ঠিকরোনো নিতম্ব বেয়ে কয়েকটা পিঁপড়ে
নিজেদের মধ্যে ব্যস্তভাবে কথা বলতে বলতে উঠে যাচ্ছে;
তুমি অনেক চড়াই উৎরাই ভেঙে এসে
ওর বুকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছো,
ওর স্তনের সুপেয় তরল কখন শুকিয়ে গেছে,
বুঝতেই পারোনি!
তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে
এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না ।


ইতিহাস মুছে দিলেও পথরেখা মোছা যায় না 




ইতিহাস মুছে দাও,  আমাদের হলুদ দস্তাবেজ,
হাতে হাতে ফেরা গোপন ইস্তাহার,
উড়ন্ত চুমুর মতো বৈদ্যুতিন সংলাপ,
স্তনে নখের ভার্চুয়াল দাগ,
গ্রাফিক ইকুইলাইজারে বানানো শীৎকার •••


মুছে দাও, আর মোছার পর যে একটু একটু দাগ রয়ে যাবে,
এসো আমরা তার ওপর দিয়ে হাঁটি,
হেঁটে হেঁটে তৈরি করি পথরেখা;
জেনো ইতিহাস মুছে দিলেও পথরেখা মোছা যায় না ,
থেকে যায় উড়ে উড়ে পড়া শিরিস ফুলের চূর্ণ,
ঘাসের ফাঁকে সোনালি সাপ
আর সাপের বুকের নিচে আবিস্কারের অপেক্ষায় থাকা গোটা একটা পৃথিবী!


লাইব্রেরি 


ওরা অনেক লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিয়েছে,  এখনও পোড়াচ্ছে,  ভবিষ্যতেও পোষাবে,
আমি এর মধ্যে অনেক কষ্টে একটা অদাহ্য লাইব্রেরি খুঁজে পেয়েছি ।
বইগুলো কেউ হ্রদ, কেউ নদী, কেউ বা সমুদ্র -
কিছুতেই আগুন ধরে না,
আমি যখন ইচ্ছে ঝাঁপ দিতে পারি,
এ ভারি মজার লাইব্রেরি!
যেখানে আসার সময় ব্যাগে সুইমিংdr কস্টিউম নিয়ে আসতে হয়!
আমি ভাসতে ভাসতে পড়ি
ডুবতে ডুবতে পড়ি
সাঁতারের চিৎ, উপুড়, প্রজাপতি, এমনকি প্রণয় -রুদ্ধ ভঙ্গিমাও আমার শেখা হয়ে যায়।
লাইব্রেরিতে তো লোকে শেখার জন্যেই আসে,  আমিও এসেছি ।
এতটাই নতশির যে  প্রবেশের দরজাই প্রথমে খুঁজে  পাচ্ছিলাম না,
তারপর দেখি, কোন দরজাই নেই
এটা একটা ওপেন লাইব্রেরি,
সবুজ সিরাপের মতো ছোট ছোট বনবীথি দিয়ে ঘেরা,
তাই অনেকেই প্রথমে  ঢোকার রাস্তা খুঁজে পায় না,
আমি পেয়েছি ।
আমি অনেক দূরের এক  গ্রহ থেকে হাঁটতে হাঁটতে
এখানে এসেছি  পাঠ করে তৃপ্ত হব বলে,
আমাকে নেবে না লাইব্রেরি?


যদি 



যদি আমার বেড়ালের নাম মজন্তালি হয়,
কিংবা আমার কুকুর পুষতে ভালো লাগে,
অথবা ধরুন আমার কোন পোষ্যই নেই,
যদি আমার নাকটা ঠিক আপনার মতো না হয়,
যদি আমার স্তন থাকে কিংবা না থাকে আর আমি একজোড়া সুডৌল স্তন নির্মাণের স্বপ্ন দেখি,
যদি আমি এমন একটা ভাষায় কথা বলি যা আপনি জানেন না,
কিংবা আমার  কোন ভাষাই না থাকে, ত।
যদি আমাদের পাড়ার সব বাড়ি রামধনু রঙের হয় ,
যদি আমরা মাঝে মাঝে  প্রথম পাতে তেতো না খেয়ে শেষ পাতে খাই,
যদি আমার বোন কাঁথা না বুনে দিনরাত আঁক কষে,
আর আমার মা ছাদে উঠে হঠাৎ হঠাৎ ঝুলঝাড়ু দিয়ে দু চারটে তারা পেড়ে আনে
আমরা খেলব বলে,
যদি আমার কোন বাপ মা নাই থাকে,
ল্যাবপ্রসূত আমাকে যদি একটা সঙ্কেত দেওয়া হয়
আর যদি সেই নম্বরটা আপনার মামাশ্বশুরের পছন্দ না হয়,
যদি
যদি
যদি
যদি
যদি••••



বিশ্বরূপ


কাল রাতে বহুক্ষণ ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হল,
কথা বলতে বলতে উনি আমার পুরোটা দেখতে চাইলেন,
আমি বললাম, 'হে ঈশ্বর, সমগ্র তো কাউকেই দেখাইনি,  খামোখা আপনাকে কেনই বা! '
উত্তরে তিনি তাঁর সেই সিগনেচার হাসিটা দিলেন,
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম তাঁর সেই কিংবদন্তী টোল,
যার গভীর গভীর থেকে জেগে উঠছে একটি ধূমকেতু,
গলগল করে বেরিয়ে আসছে অগণিত ঈশ্বরকণা,
আর বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে
আমি খুলে ফেলছি আমার ছোট বড় মাঝারি সমস্ত পোশাক,
এমনকি আমার ক্ষতস্থান খুলে দিচ্ছি,
আর আমার পুতনা স্তনে ঢেকে ফেলছি তোমায় বিশ্বরূপ!


সরিফুল যখন নাচছেন 


সরিফুল যখন নাচছেন,
নোয়াখালি,গোধরা, গুজরাত, বাবরি
উড়ে যাচ্ছে ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো!

কেরলের এই যুদ্ধনৃত্য শেখার জন্যে
সরিফুল বিন্ধ্য পেরিয়ে অনেক অনেক দূর গেছেন,
হাঁটতে হাঁটতে তিনি কখনো বাসুদেব,
কখনো বিজয়, কখনো বা চিরঞ্জীব-
হিন্দু ছাড়া এ বিদ্যা যে কাউকে শেখানো হয় না,

কিন্তু সরিফুল,
অজ্ঞাতবাসের সময় আপনার অস্ত্রগুলি যে শমীবৃক্ষে বাঁধা ছিল,
সেই বৃক্ষটির ধর্ম কী?
কী ধর্ম ওই পর্বতগুলির
যাত্রাপথে যাদের আপনি বলে গেছিলেন
'মাথা নিচু করে থাকো, আমি আবার ফিরে আসব '

আপনি কথা রেখেছেন,
সংহারের যাবতীয় মুদ্রা আয়ত্ত করে ফিরে এসেছেন,
আপনার প্রলয় নাচনে কেঁপে কেঁপে উঠছে
আসমুদ্রহিমাচল এই ভারতবর্ষের ভূমি,
মাটিতে কান পেতে বুঝতে পারছি
কেঁপে উঠছে গোধরা থেকে গুজরাত,
কিন্তু আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,
আপনি ফিরে আসার পরে
আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিন্ধ্য,
শুধু আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে ।


শান্তি ও কল্যাণ 


আমার এখন কোন মুখ নেই,
আমার এখন কোন চিৎকারও নেই,
সব শান্ত হয়ে গেছে,
শান্তি ও কল্যাণ চতুর্দিকে,
কল্যাণ রাষ্ট্রে কোন হিংসা নেই,
সেতুগুলি নিরাপদ,
বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যায় দধিকর্মা হাঁড়ি-
হে অগ্নি উৎসব করো, নগর-বাওয়ালি
হে মাটি উৎসব ধরো, শাহাদাত বালি
জেনে যাও আমার এখন কোন মুখ নেই,
আমার এখন কোন চিৎকারও নেই!

পুনশ্চ -
কেন কি মাটিই জানে, মাটি সব জানে
যতই বাওয়াল করো এখানে ওখানে -
ডিকি ভরা লাশ আর গোলা ভরা ধান
পায়ের তলায় নাচে শালা ভগবান!

2 comments:

  1. ভালো লাগলো। সবই কবির সিগনেচার কবিতা।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ । একেবারে অন্য রকম । বার বার পড়তে হয় ।

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ