Tuesday, December 24, 2019

অচিন মিত্র






সাম্প্রতিক অবস্থা ও আমাদের রাজ্য


আমাদের দেশের সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই কয়েকটি একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে আমায় কথা বলতে হবে।
হয়তো একটু মৌলবাদী কথা হয়ে যাবে, তবু বলি -- যতদূর দেখেছি, বিহার আর উত্তরপ্রদেশের লোকের একটি বড় অংশ ( শাসক এবং শাসিত উভয়েই) বেশ গোলমেলে। হয় তারা কট্টর উগ্র হিন্দু, নাহয় কট্টর উগ্র মুসলমান। ধর্ম আর জাত নিয়ে এদের জীবনের সবকিছু স্থির হয়।
তাছাড়া বিহার বা উত্তরপ্রদেশের থেকে প্রচুর লোক জীবিকার কারণে বা অন্যান্য কারণে নিকটবর্তী যে দুটো মহানগরে আসে, সেগুলো দিল্লি আর কলকাতা। দিল্লির নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই তেমন (আমি ছাত্ররাজনীতি বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই হিসেবের বাইরে রাখছি)। জায়গাটাও ছোট। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ লোক (হিন্দু হোক বা মুসলমান) সাধারণত এইধরণের উগ্র বা কট্টর নয়। কিন্তু এই রাজ্যে এই বিহার আর উত্তরপ্রদেশের লোক আর গত ১0 বছরে আসা বাংলাদেশের লোকেরা (হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই) এই জনজাতির সঙ্গে মিশে এর চরিত্রটাও পাল্টে দিচ্ছে। এই উগ্রতার খানিক শিকার এখন এই রাজ্যের লোকেরাও। তাই পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কিন্তু বিহার বা উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে এক মাপকাঠিতে ফেলে বিচার করলে চলবে না। একে স্বতন্ত্রভাবে বিচার করতে হবে।
সবাই জানে, বিজেপি একটা হিন্দু মৌলবাদী দল। তারা তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টেরই চেষ্টা করবে, মুসলমান সম্প্রদায়ের উপরেই আক্রমণ চালাবে। কারণ তাদের একটা শত্রুপক্ষ চাই, ধর্মের মদ খাইয়ে লড়াই বাধানোর জন্য। এবং ইসলাম মৌলবাদের কাঠামো ধার করেই মোটামুটিভাবে তৈরি হয়েছে এই হিন্দু মৌলবাদের ধাঁচা। কিন্তু এগুলো তো জানা কথা! তাই তাদের থেকে কি -- তাদের দলের লোকেরা ছাড়া আর কেউ -- এর থেকে বেশি কিছু আশা করেছিলেন? কিন্তু এসবের পাশাপাশি অনেকের আলোচনায় (বিশেষত তথাকথিত ডিগবাজি খাওয়া বুদ্ধিজীবী ও ফেসবুক-বিপ্লবীদের) অনবদ্য এক যুক্তিক্রম উঠে আসছে। একই যুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে, অথচ তার ফল দেখুন --
১) সিপিআইএমের অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সে গেলে হয়তো এর থেকেও খারাপ কেউ আসবে। সে আসুক। কিন্তু এর হাত থেকে রেহাই চাই। একে আর নেওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু পরবর্তীকালে? এরাও খুব খারাপ। একে আরওই তো সহ্য করা যাচ্ছে না। কিন্তু কী করবো? এ গেলে তো বিজেপি আসবে। তাই এরা খারাপ হলেও একেই নির্বাচন করি।
অহো, একই যুক্তির কী চমৎকার বিপরীত সিদ্ধান্ত!!!
২) কাশ্মীরে যখন গুজব ছড়ানোর আশঙ্কায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সেটা গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। কিন্তু আমাদের রাজ্যে যখন সেটা অনেকগুলো জেলায় করা হয়, তখন শাসকের সেটা করার কারণ -- গণতন্ত্র যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে, দাঙ্গা না হয়, সেই শুভ কামনায়। একইভাবে রাজ্যপাল ডাকলেও ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ্যসচিব এবং ডিজি-র না যাওয়া গণতন্ত্রের স্বার্থে। অর্থাৎ আমি করলে সবই ঠিক, সবই ভালো, সবই দেশের স্বার্থে, সবই মানবতার জন্য। কিন্তু অন্যে করলেই মুশকিল। আমি কোনো কিছুর বিপক্ষে থাকতেই পারি। কিন্তু একটি দেশের একটি আইন পাশ হওয়ার পর সেই দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান কিভাবে প্রকাশ্য পাবলিক মিটিংয়ে বলতে পারেন যে, আমি এই রাজ্যে কিছুতেই এসব বলবৎ হতে দেবো না? একইভাবে তাঁর সরকারের অধীনস্থ কোনো কর্মচারী যদি তাঁর কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই একই কথা বলে, যদি কোনো দপ্তর চালাতে চান, বা ওই মুখ্যসচিব বা ডিজি যদি তিনি ডাকলেও না যান, তাহলে তিনি সেটা মেনে নেবেন তো? আর প্রশাসনিক আচার লঙ্ঘন করে সবই যদি করা যায়, তাহলে আইন বলে একটি প্রহসন রাখার আর কী দরকার দেশে? যা খুশি করলেই তো হয়!
৩) অন্য জায়গায় যখন ধ্বংসের তাণ্ডব চলে, তখন সেখানে পুলিশের না পৌঁছতে পারা এবং প্রশাসনের মুখ্য পদাধিকারীদের না-যাওয়া অপদর্থতা। কিন্তু নবান্ন থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে যখন সেইরকম ঘটে (একটা গোটা রেলস্টেশন নিশ্চই মাত্র আধঘন্টার মধ্যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পুরো ছাই করে ফেলা বা পনেরোটা বাস পুরো পুড়িয়ে ফেলা যায় না!), তখন কিন্তু সেটা শান্তিরক্ষার স্বার্থে। ক'জন দাঙ্গাকারী গ্রেপ্তার হয়েছে? মুসলমানদের গ্রেপ্তার করলেই আমি সাম্প্রদায়িক, সেটা করলে দাঙ্গা বেধে যেতে পারে, এই যুক্তি হিন্দুদের একটা বড় অংশ মেনে নেবে কেন? কিন্তু অশান্তি সৃষ্টিকারীরা কতজন কোন ধর্মের? তারা কি কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক? হলে কোন কোন দলের? পুলিশের হাতে লাঠি বন্দুক কাঁদানে গ্যাস, জলকামান -- এসব ছিল না? তাহলে কেন ঠেকানো গেল না? এসব প্রশ্ন করলেই তুমি ষড়যন্ত্রকারী। দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে না নাকি মানবতার কারণে। তাহলে আমরা বসে বসে মানবতা দেখাই, আর দাঙ্গাকারীরা এসে আমাদের সব জ্বালিয়ে দিয়ে যাক। চমৎকার! তা, এইসব মানবতার জন্য নানা প্রতিবাদের ডাক দিচ্ছেন যাঁরা, এ রাজ্যে তৃণমূলের অমানবিক নানা কাজে তাঁদের প্রতিবাদী মানবতা জেগে ওঠে না কেন, কে জানে!!!
4) পৃথিবীর সবথেকে জনঘনত্বপূর্ণ দেশ ভারতবর্ষ। এবং সে দেশের সবথেকে জনঘনত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। সেখানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের (সেটাও ২০১৪-র -- মানে মাত্র পাঁচ বছর -- আগে থেকে) কথা বললে সেটা অন্যায়। একেই এই রাজ্যে বিহার, উত্তরপ্রদেশের লোকেরা আর মাড়ওয়ারিরা এখানকার বাঙালিদের অনেক জায়গায় কোণঠাসা করে দিয়েছে। এরপর যদি অন্য দেশ থেকেও আরও লোক আসে, তাহলে এখানকার লোকেদেরই তো এখানে অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে! একটা জায়গায় এসে তো তার বাঁধ দেওয়া দরকার! এই পর্যন্ত আইনগতভাবে যুক্তি ঠিকই আছে। কিন্তু কী অদ্ভুত! ওইসময়ে (২০১৪-র পর থেকে) হিন্দুদের অনুপ্রবেশ অন্যায় নয়, কিন্তু মুসলিমদের অনুপ্রবেশ অন্যায়। অর্থাৎ শুধু ধর্ম পাল্টে গেলেই ন্যায়টা অন্যায় আর অন্যায়টা ন্যায় হয়ে যাচ্ছে। এইখানে এসে বোঝা যায় যে, নাগরিকত্ব আইন কিন্তু আইন হিসেবে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সমস্যা হলো এ আইন যে শাসক বলবৎ করতে চাইছে, তার এপ্রোচে। তাদের উদ্দেশ্য সৎ হলে তারা আইনকে সবার জন্য সমান করতো। তা হিন্দুর জন্য একরকম আর মুসলমানের জন্য আরেকরকম হতো না। অর্থাৎ এ আইনকে শুধু মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করে তার পিছনে একটা হিন্দু মৌলবাদী মুখের উগ্রতা আর ঘৃণা কাজ করবে না তো? কিন্তু হিন্দু পাঁচ-পাবলিকের কাছে এই আশঙ্কা যে মাথা তুলতে পারে না এখানে, তার একটা বড় কারণ হলো -- তারা চোখের উপর দেখে যে, একইসঙ্গে এই তাণ্ডব যখন হিন্দুরা চালায়, তখন খুব সঠিকভাবেই আমরা হিন্দু মৌলবাদের নিন্দা করি। কারণ তা অন্যায়। কিন্তু এটাই যখন মুসলমানরা করে, তখন সেটা 'ঠিক না' বলেই আমরা তারপর একটা 'কিন্তু' জুড়ে দিয়ে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পরোক্ষে তাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। তখন মুসলিম মৌলবাদ এবং তাকে তোল্লাই দেওয়াকে জোর গলায় অন্যায় বলা বা তার প্রতিবাদ করার জন্য কেউ ব্যগ্র হয়ে উঠি না, পাছে লোকে সাম্প্রদায়িক বলে! একইভাবে আমরা নিজেদের প্রগতিশীল প্রমাণের জন্য বিদেশি সাহিত্যিকের উদ্ধৃতি দিই যে পোশাক দিয়েই নাকি দাঙ্গাকারীদের চেনা যায় আর তার সঙ্গে আর এস এসের পোশাক পরা মোদীর ছবি দিই। আপাতভাবে ঠিক কাজই করি। কিন্তু যখন মোদী বলে যে -- যারা ভাঙচুর চালাচ্ছে, তাদের পোশাক দেখেই বোঝা যায় যে তারা কারা। তখন সেটা দাঙ্গার জন্য উস্কানি হয়ে যায়। আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কী ঠুনকো! আর একদল রাজনীতিবিদ সেই হিন্দু মৌলবাদকে ভোটের কারণে উস্কানি দেয়, আর আরেকদল (যাদের গায়ে মৌলবাদের তকমা নেই) মুসলিম মৌলবাদকে ভোটের কারণে উস্কানি দেয়। তাদের তো পুরোটাই লাভ! হিন্দুই মরুক আর মুসলমানই মরুক, মরলে তো মরবে ওই গরুছাগলের দল ভোটদাতাগুলো!! নিজেদের চিন্তা শুধু ক্ষমতারক্ষা নিয়ে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, যখন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রায় দাঙ্গা-পরিস্থিতি ঘনিয়ে উঠেছে, তখন এই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যথার্থভাবেই বলেন যে -- আমরা এই রাজ্যের একটিও মসজিদ ধ্বংস হতে দেবো না। কিন্তু সেই ভোটের রাজনীতিই ভুলিয়ে দেয় মসজিদের সঙ্গে-সঙ্গে মন্দির শব্দটিও জুড়ে দিতে। কিন্তু এই ভুলগুলোর ফল হয় সুদূরপ্রসারী। হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে অল্প অল্প করে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। এগুলো তো সামান্য ব্যাপার -- বলে আমরা বরাবর পাশ কাটিয়ে এসেছি বলেই সেইসব ভুল আজ রাক্ষস হয়ে আমাদের গিলতে আসে। এখন আর আক্ষেপ করে লাভ কী!
৫) এই বিপুল ভাঙচুর ও তছনছ করে নাকি নিজেদের প্রতিবাদের ক্ষমতা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু ধরা যাক, যখন চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়, তখন কি সেটা বেছে বেছে বিজেপি বা তৃণমূল বা সিপিএমের গায়ে গিয়ে পড়ে? নাকি বেছে বেছে হিন্দু বা মুসলমানের গায়ে গিয়ে পড়ে? যখন একের পর এক বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই বাসের মালিক কোন ধর্মের বা কোন পার্টির দেখে করা হয়? আর যখন জনগণের টাকায় তৈরি রেলের লাইন উপড়ে বা স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন আদতে ক্ষতি হয় কার? কিন্তু এই কাজগুলোই যখন একদল মানুষ করে, তখন আরেকদল মানুষ এগুলো কত খারাপ তাই নিয়ে ভাষণ দেয়। অথচ ওই একদলের হাতে ক্ষমতা এলে, তখন তাদেরই কাজের প্রতিবাদে আবার এই আরেকদল ঠিক একই কাজগুলো প্রতিবাদের অঙ্গ হিসেবে করে। তখন সেটা জাস্টিফায়েড। তখন আবার ওই একদল ভাষণগুলো দেয়।
৬) যখন মহরমের মিছিল বের হবে  বলে দুর্গাপুজোর ভাসান বন্ধ করে দেওয়া হয় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে ঝামেলা না বাধে সেই অজুহাত দেখিয়ে, তখন তো আমরা বলি না যে ভোটের ফায়দা তোলার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকেই তোল্লাই দেওয়া হচ্ছে? কারণ ভাসানের মিছিল বেরোয় সন্ধের পরে। আর মহরমের মিছিল শেষ হয় সন্ধের আগেই। ভাসানের মিছিল অবশ্যম্ভাবীভাবেই শেষ হয় কোনো পুকুর, খাল বা নদীতে, কিন্তু মহরমের মিছিলের তেমন কোনো বাধ্যতা নেই। ফলে পুলিশ ও প্রশাসন দুটোর রুটম্যাপ আলাদা করে দিলে কোনো সমস্যাই হয় না দুটো একসঙ্গে হওয়ার। কিন্তু কোনো এক অজানা অনুপ্রেরণায় তা হয় না। এবং তা নিয়ে পাল্টি খাওয়া বুদ্ধিজীবীরাও বোবা হযে থাকেন, মানবিকতার ধ্বজাধারীরা কায়দা করে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যান। ক্রমাগত এইসব কাজের একটা সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া তখন তলে তলে ঘটে যেতে থাকে। সেটা আমরা টের পাই না বা পেয়েও না দেখার ভান করে থাকি। ফলে বিষ ছড়িয়ে পড়ে ক্রমাগত। আর সেই বিষ এখন বাড়তে বাড়তে এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছেছে যে তার নিরাময় হওয়া খুব কঠিন।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ