Tuesday, December 24, 2019

রঘু জাগুলীয়া





 লবণাক্ত

হেঁতালবন থেকে মুখ বাড়িয়েই হাঁকডাক দিয়ে তিনি চলে যায় আরো গভীর জঙ্গলে। হরিণ এসে জল ছুঁতেই ভয় ভয় করে। কি এক দুশ্চিন্তায় হু হু করে প্রাচীন শৈত প্রবাহিত হয় সারা শরীরজুড়ে। হাঁসগুলো লি লি কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসে কোনো এক ঋতুর পাড়ে। গাছগুলিরও শিত্তি লাগে,রক্ত লেগে থাকে, পাতার নীচে কিলকিল করে পিঁপড়েরা তড়িঘড়ি নেমে আসে মাটির কাছে। মাটির ভিতর ছিদ্র দিয়ে পিঁপড়েগুলি কোথায় চলে যায়, বোঝা যায় না। মাস্টারমশাই টর্চ জ্বালিয়ে বাড়ি ফেরেন একা, নাবাল মাঠ পেরিয়ে কয়েকটি নারকেল গাছ যেদিকে নুনমাটির উপর জোছনায় ফরফর করে--সেখান থেকে সময়পা' চালিয়ে চলে যান পারদের মতো চিকচিকে চরে। ভিনরাজ্যে খাটতে যায় সব দশকেলাশ পর্যন্ত গুঁতোগুতি করে। কাপড়ের ব্যবসায়, ধান রুইতে,মার্বেল বসাতে আরো কত কত কাজে। আঠারো ছুঁলেই যাত্রাপালা করবে বলে বিয়ে করে বৌ নিয়ে আসে। সেই মুখগুলো একদিন কুলোয় পোকা চাল বাছে, ডোবার কলমি শাক আঁচলভরে তোলে, চোখগুলো হলুদ হয় তাদের, হিমোগ্লোবিন শুষে নেয় জল, উপসী সন্ন্যাসিনী হয়ে ওঠে গ্রাম্য রাধাচূড়া ফুলগুলি। এরমধ্যে শিয়ালগুলো বলে গেছে, একাত্তরের আগের কাগজ না দেখাতি পারলি তোগো ভিটে সব বাজেয়াপ্ত হইবে।

             অমূল্য মনে করে,কুড়ি বছর আগের একটি গ্রাম। শীতভোরে তিনটে থেকে উঠেই একদল পাড়া রণসাজে কাঁখে হাঁড়ি আর কাঁধে মশারির জাল নিয়ে গাঙে মিন ধরে ধরে-- সাতসকালে পানীতে পাছাজাপড়ে ভেসে ভেসে আবার পাড়ার মধ্যে ফিরে আসে। কামোটের মুখে, কুমিরের মুখে পা পুরে অনেকেই আবার ফিরতে পারেনা। পরাণচাচার ঘরে গরাণ ছিটের গায়ে নোনাপাঁক লেপা। মাথায় আমনের গলাকাটা ধড়টুকু বিন্যস্ত। গরম কালে গা থেকে চিড়চিড় করে খসে পড়ে নোনাধুলো। তার পর স্যাঁতস্যাত করে দাওয়া। খাটের উপর বিড়াল লাফিয়ে ওঠে। পরাণচাচা পাশের পাড়া থেকে চাকনে ভর্তি গাঙের চুনোমাছ নিয়ে আসে ঘরে ঘরে। বদলে পুঁইশাক,কচুশাক, লাউডগা নেয়। তারপর উঁনুনে কারো আগুন জ্বলে, কারো কপালে পোষ্টি ভাত।কড়াইয়ে আঙুলচেপে সর্ষেতেল গিয়ে পড়লে--খুন্তি নাড়ার শব্দ হাগাঘর থেকে শুনতে পায় অমূল্য। গর্তের উপর গাছের গুঁড়ি ফেলা, তার উপর গোড়ালিতে পাছা ঠেকিয়ে ইষ্টনাম করতে হয় সেই কত্ত ছোটবেলায়। ঘরটুকু ছাড়া অতিরিক্ত মাটি ছিলনা যাদের, তারা খালপাড়ে, গাঙচরে, ঝোপগাছের গায়ে কাপড় জড়িয়ে ইষ্টনাম করতো। পরাণচাচা এদিক-ওদিক করে আট-ন'বছরে এসেছিল, তারপর আর এলো না। সেই থেকে মিন'ও শেষ হয়ে গেল। লাল, সবুজ, হলুদ কত রঙের পাতা, শুখনো ডাল ভেসে যায়, গেঁজে ওঠে গাঙের পানীতে। মিন রক্ষাকমিটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না, প্রযুক্তিগুলো শীতঘুম দেয়। চারপাশে কচ্ছপের মতো ভেসে থাকে গ্রামগুলি। তাও একদিন গর্তটির সমীক্ষা, কত রকম যোজনা করে সরকার। শুরু হয় স্যানিটেশন আর সাক্ষরতা মিশন। খেতে না পেয়ে তো কত মানুষ মরে। লেখাপড়া করবে কি করে! সব নাঙের ঘরে গিয়ে করে। ঠাকুরঘরের সামনে ভর পড়ে রুটির মতো বেলা' খায় কাকলিমাসি। একসময় পর বলে তর কি চাই? আইজ্ঞে ছ্যালেটা! তর ছেলে এই গ্রাম থেইকা তিনটে শহর দূরে। আর একজন গিয়ে বলে, এবার কোটালে কি ফিরবে? তরটা, তেরো নদীর পারে যাইছে, আসতি সময় লাইগবে। কাকলির চোখ বন্ধ, চুলের জটে মাটি উঠে আসে।
হেঁতালবন থেকে তিনি প্রতিনিয়ত মুখ বাড়ান, হঠাৎ হঠাৎ এক একটি সিং উঁচু হরিণকে ঘাড় মুচড়িয়ে তুলে নেয় ইচ্ছেমতন।

             অমূল্য মনে করে,তার বাপকে বুককাপড়ে জড়িয়ে-- তারও ত্রিশ বছর আগে তার ঠাম্মা কালিন্দীতে ঝাঁপ দেয়। রায়মঙ্গলে তখন ক্রন্দনবিলাপ করে নৌকোগুলি, ডুবেও মরে অনেকেই। সেও পরাণচাচার গ্রামে এসে আন্দোলনকারীদের হাতে-পায়ে পড়ে মাথাটুকু গোঁজার জন্য একটুকরো জমি পেয়েছিল। তার উপর সেটাই হয়ে উঠেছিল একসময় ভিটে। হোগলাপাতায় ছাওয়া সংসার। জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে, পাতা কুড়িয়ে, ধোঁয়ায়--কুচোমাছ, থোড়, শ্যাপলা,কাঁচাতেতুল সেদ্ধ করে খায়। পাঁচপয়সার দেশলাই কিনতে গিয়ে ফিরে আসতো দোকান থেকে, পাশের বাড়ি থেকে লম্ফ জ্বালিয়ে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ দিতে গিয়ে বলতো, ও মা মনসা, তুই আমারে মাইরা ফ্যাল। এ জনমে তুই না দিলি ঘর, না দিলি ভাত, না দিলি তারে ! জঙ্গলের সবুজ পাখিগুলোর পা অর্ধেক উপড়ে গিয়ে পড়ে গাঙের কোলে, মাথা নীচু করে পানীর ভিতর ছুঁয়ে রাখে ঠোঁট। ঢেউ চলে গেলে মানুষগুলির কাঁধ থেকে নুনজল সরে যায়, বাকলের চকলা ওঠে চৈতমাসের মাঠে। জল এসে খুবলে খুবলে খায় ভেড়ি'। ঠাম্মার এক মেয়ে ছিল, সে নাকি আঁটল পাততে যেত। একদিকের সায়া কোমরে গুঁজে জল কেলি করে দাঁড়াতো, ছর ছর করে বৃষ্টি নামতো আকাশ থেকে। ঠাম্মা বলতো মুখপুড়ি, ভাতারসোয়াগী, তাগো ঘর গিয়া বমি কর । অক্ত বমি কইরা মর ধাড়ী। আর জ্বালাসনি আমাগো। একদিন শোনা যায় গোয়ালঘরে আড়ায় ছাগলদড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে সে মেয়েটি। আঁশবটি দিয়ে সেই দড়ি কেটেছিল পাড়ার লোক। ঠাম্মা তারপর আর মাছ ছুঁতো না। বাতের যন্ত্রনায় বিছানা নিলে, অমূল্য ছোট্টবেলায় তেল দিয়ে ডলে দিত ঠাম্মার পা। তার পর চুপসানো মাইগুলো নিয়ে চটকাতো, মুখ দিয়ে চোঁ চোঁ করে আওয়াজ করতো। ঠাম্মা দু-অক্ষর, চার অক্ষর খিস্তি করে গলা খেঁকিয়ে বলতো, তর বাপ ভালা লয়, তর মা ভালা লয়, তর দেশটাও লয় ! তার পর তাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠতো, তর পিসি ভালো, তুই ভালো, আর তিনি ভালো...

               ইশকুলের খাতায় নাম ওঠে, অমূল্যচাঁদ খাড়া। মাস্টোমশাই জিগায়,তর বাপের নাম কি? অরূপচাঁদ খাড়া। মা? চন্দ্রমণি খাঁড়া। ও পলা, তরা দেখছি সব চাঁদির বংশো। মাস্টারমশাই-এর চোখে সালফার পড়া ঝাপসা চশমা, পায়ের চেটো বেঁকে আঙুল জুড়ে থাকে, কাদা লেগে শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। অমূল্য পড়ে অ-অজগর আসছে তেড়ে, আ-য় আমড়া দেবো ছুড়ে। ঘুঘু এসে ঘুরে বেড়ায় ইশকুলের বারান্দায়। মাস্টারমশাই হাত উঁচু করে, অমূল্য আরো চিল্লিয়ে পড়তে শেখে, ঘুঘুরা পা টিপে টিপে ইশকুলের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। অমূল্য কলেজ পাশের পর বছর পাঁচেক কাজের খোঁজে খুব দৌড়াদৌড়ি করে এসে দাঁড়ায় পিচ রাস্তার মুখে। মানসনেত্র পুরে দেয় চারপাশে। গোস্ত নিয়ে বাড়ি ফেরা বুড়োকে পিটোচ্ছে একদল ষন্ডামার্কা ছেলে, ম্যানহোলের ভিতর থেকে উঠে আসছে এক একটি নিথর পাঁকলেপা আপাদমস্তক, এক একটি নলকূপের সামনে অসংখ্য ফাঁকা ড্রাম-হাঁড়ি-কলসি হামাগুড়ি খাচ্ছে, বুলেট ছ্যাঁদা করে যায় সাংবাদিকের চোখ- প্রজাতান্তিক মানুষগুলোর পেট , কাশ্মীর থেকে আসাম লক্ষ্ণৌএ প্রতিদিন কবন্ধ লাশগুলি থরেথরে এগিয়ে যায়, ধম্ম ধম্ম খেপিয়ে দেয় পার্টির লোকগুলো , ওদিকে ভিটেছাড়ার বিল পাশ হয় দিল্লীর ক্যাসিনোতে।
শেয়ালগুলো মাইক নিয়ে মস্তানি মারে, বিশ্ববিদ্যালয় গুঁড়িয়ে দেবে বলে। মাস্টামশাই টর্চ লাইট জ্বেলে হেঁকে বলে, জেটপ্লেন হইয়্যা দৌড়া অমূল্য। সারারাত হেমন্তের আল জমি দিয়ে ছোটে। ধানের শিষ গর্ভভারে মাটির বুক ছুঁয়ে ঘুমোয়, গাছের পাতা চুঁইয়ে টপটপ শিশিরের কান্না শোনা যায়, কুয়াশার মধ্যে সেই উঁচু আলো কোথাও চোখে পড়েনা তার। অমূল্য ধানশিষের মাথায় হাত বুলোয়,চুমু খায় তার পেটে। তারপর মৃদুহাস্যে বলে, উ শালা, তোগো দেশ কুথায়? তুরা কুথায় থাকবি? অমূল্য কাগজ হাতে দৌড়ায় এক দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে। কাগজ ছুঁড়ে মারে চুলোর আগুনে। ন্যাংটো হয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে গিয়ে গণতন্ত্র মুঠো করে ধরে।সওয়ামারানীর দ্যাশ দিছে ঈশ্বর! দ্যাশ! এই নে শুয়ারীর বাচ্চা, তোগো স্বৈরাতন্ত্র। ছুরি দিয়ে কেটে ভোটের তাবিজ দিয়ে আসে সরকারকে। ইশকুলে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কত কত মিটার গোল হয়ে দৌড়েছে সে। এখন ঘন্টায় কিলোমিটার পেরিয়ে মাইল মাইল ছোটে। তবু প্রিয় ইশকুলকে খুঁজে পায়না সে। তরুচ্ছায়ায় যেখানে অন্ধকারের পর্দা উঠে যায় ধীরে ধীরে, মাস্টামশাইরা হাতে হাতে লম্বা করে লাল ফিতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, সারাদিন আকাশের মেঘগুলোকে মুষ্টিহাতের ধাক্কায় ভেঙে দেয়। টর্চ লাইট পড়ে থাকে বাদাবন পেরিয়ে পরাণচাচার ভিটেটুকুন জুড়ে। ওদিকে যাবে বলে কোথায় যেন চলে যায় অমূল্য। সজনে গাছে ফুল আসেনি এখোনো। তিনি হেঁতালবন থেকে এসে আমনের ফসল দাবিয়ে যায়। মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকায় অমূল্য। নুনমাটির মতো সাদা হয়ে ওঠে শরীর, হিমোগ্লোবিন শুষে নেয় প্রতিদিন নোনাজল, ম্যানগ্রোভগুলির শিকড় মাটির উপরে নিশ্বাস নিতে থাকে।





No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ