Wednesday, December 25, 2019

বেবী সাউ






তুমি কে হে শাসক ভালোবাসার ওপর 
রক্ত ঢেলে দেওয়ার?



আমাদের দেশের বাড়ির উত্তরে বেড়া দেওয়া; তখনও উঁচু পাঁচিল ওঠেনি। আর বেড়ার ওপারে একটা শত্রুজাত সংসার।  আমার দোদণ্ডপ্রতাপ দাদু সেই শত্রুদের উপর কিছুতেই নিজের অধিকার ফলাতে পারছিলেন না, আর ওরাও কিছুতেই মানতে পারছিলেন না দাদুর শ্রেষ্ঠতা। স্বাভাবিকভাবেই দ্বন্দ্ব এসে পড়ে। আর তার ফলভোগ করি আমরা, বাদবাকি জীবেরা। যাদের নিজস্ব কোনও মত নেই, অধিকার নেই এমনকি পদ নেই।  দাদু নিজস্ব মেজাজে
সমস্ত পরিবারের ওপর চাবুক ঘুরিয়ে চলেন, আমরা অসহায় প্রানীকুল সেই ছড়ি র গতি প্রকৃতি অনুসারে জীবনযাত্রা সাজাই। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করি। সুতরাং,  ওই বাড়ির কৎবেল, আমড়া কিংবা বাতাবিলেবু কখনও আমাদের আর খাওয়া হলো না। মা-কাকীমারা বেড়ার এপাশ থেকে অতি সন্তর্পণে কিছু কিছু কথা চালান করতে পারতেন যদি দাদু যেতেন পেনশনের টাকা তুলতে কিংবা অন্য কোনও কাজে।  যাইহোক,  এইযে আমাদের বাড়ি, আমাদের সাম্রাজ্য যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার দাদু। আর আমরা ছিলাম তাঁর ঋণগ্রস্থ প্রজা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি, সারাবাড়ি থমথম করছে। দাদু মুখ ভার করে বসে আছেন সদর ঘরে। ঠাকুমা গলায় আঁচল জড়িয়ে একমনে মালা জপ করছেন একমনে। হঠাৎ এরকম একটা পরিস্থিতিতে ঢুকলে যা হয়...মায়ের কাছে জানলাম, আমার কুলাঙ্গার(দাদুর মতে) জেঠু ওই বাড়ির অসুস্থ  ঠাকুমাকে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালে। আর তাতে এই। রাতে জেঠু ফিরলে, বিরাট কিছু হবে ভেবে আমাদের ভাইবোনদের তাড়াতাড়ি ডিনার করিয়ে দেওয়া হল। কেউ আমাদের আর পড়াশোনা করার জন্য চাপও দিল না। সমস্ত বাড়ি যেন একটা গুমোটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর আমরা নিশ্বাস নিচ্ছি এমন ভাবে যাতে শব্দ না হয়।

তো,  তখন রাত ন'টা হবে বোধহয়।  জেঠু এলো।  হাত-পা ধুয়ে গামছায় মুছছে। "বৌদি কেমন আছেন?" লে!শেষে দাদু? দাদুই পালটে গেলেন!  কোথায় গেল রাগ? কোথায় গেল আইডেন্টিটি? কোথায় গেল যাবতীয় রুলস?  রীতি?  আসলে এতদিন যা ছিল রুলস, রেগুলেশন তাকেই আমরা অনিবার্য মেনে এসেছি। তাকেই আমরা রাষ্ট্র ভেবে এসেছি। কিন্তু যখনই কেউ এসে বললো আমি এই নিয়ম মানি না, এই যুক্তি মানি না তখনই নত হয় নিয়ম, শাসক এবং তার শাসন।

সত্য আমরা সবাই জানি। এই মানচিত্র, এই দেশ, এই রাষ্ট্র,  শাসক এবং শাসন আসলে সবই ক্ষণস্থায়ী এবং ভঙ্গুর। বারবার মানচিত্র পালটায়, দেশ পালটায়,  শাসক, শাসন পালটায় কিন্তু পালটানোর জন্য জাগতে হয়, উঠে দাঁড়াতে হয় সেই  আপাত নিরীহ,  অসহায় মানুষকেই। আজ যদি আমাকে প্রণাম করতে হয় আমিই আমি! আমার কথাগুলো আমার,  আমার লেখাগুলো আমার, আমার বলা, চিন্তা, ভাবনা,  যুক্তি -- এসব আমার! আর সেটা প্রমাণ করতে হবে শাসকের মতো করে? যে শাসক অত্যাচার করতে পারাটাকে বিজয় মনে করে, উল্লসিত হয়? সামান্য কাগজের দাম আছে কিন্তু একটা জীবনের দাম নেই? সামান্য মাটির দাম আছে কিন্তু 'মা'-এর দাম নেই?

আজ যদি আমার মা'কে,  যে আমার জন্মদাত্রী আর আমাদের এই ১০০০স্কোয়ার ফিট বাড়ির মালিক, হিসেব মতো তিনিই আমার সবকিছুর মালিক, এমনকি আমার জন্মেরও, তাকে যদি সবসময় আমার বার্থ সারর্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় "এই দেখো, এই আমার জন্মতারিখ, আমি কি বাথরুমে যাবো? " "এই দেখো, আমার বার্থ সার্টিফিকেট আমি কি তোমার রান্না খেতে পারি?" --- ব্যাপারটা যেমন হাস্যকর তেমনি অসম্ভবও বটে।

আবার যদি উল্টোটা ধরে বলি, ধরুন আমাদের পাড়াতুতো কেউ এসে বললেন " কই তোমার বার্থ সার্টিফিকেট দেখি? সত্য সত্যিই তুমি তোমার মায়ের মেয়ে কি না?" তখনই কি আমি তেড়ে গিয়ে বলবো না, "তুই কে রে?" আর এসব জায়গায় কাগজপত্র কতটুকু ভূমিকা গ্রহণ করে?

আমি আমাদের গ্রামে দেখেছি অধিকাংশ মানুষের কোনও কাগজপত্র ঠিকঠাক নেই। কিন্তু কত কত পুরুষ ধরে তারা এই মাটিকে,  জমিকে, আমাদের ছোট্ট খালটিকে, বৃদ্ধ বটগাছটিকে ভালোবেসেছেন। শ্রদ্ধা করেছেন। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ঐতিহ্য,  সংস্কৃতি।  দুঃখে কেঁদেছেন, আনন্দে ভেসেছেন --- আর এখন যদি বলা হয় এইযে তোমরা নদীকে, নালাকে, আনন্দকে, দুঃখকে ভালোবেসেছ তার প্রমাণ দাও! কাগজপত্র দেখাও--- সেটা কী সম্ভব? 

গ্রামে, আমি দেখেছি বিয়ে হয় অগ্নিকে সাক্ষী মেনে, কোনও কালো কোট পরা অপরিচিত উকিলকে মেনে নয়। আমি দেখেছি, বাচ্চার জন্মসাল মনে রাখা হয় মন্বন্তর কিংবা বন্যাকে সাক্ষী মেনে। আমি জানি আমার দেশের অধিকাংশ কৃষক ফসল ফলান যে জমিতে সেই জমির কোনও কাগজপত্র তার কাছে ফাইলবন্দি হয়ে গুছানো নেই। শুধু মুখের কথা এবং ভালোবাসার সূত্রে বছরের পর বছর তারা জমি থেকে, বুকের ঘাম পায়ে ফেলে দু' মুঠো অন্ন জোগাচ্ছেন রাষ্ট্রের মুখে।

তুমি কে হে রাষ্ট্র,  এসবের কাগজ পত্র খোঁজার? তুমি কে হে শাসক ভালোবাসার ওপর রক্ত ঢেলে দেওয়ার?  তুমি কে হে দেশ সীমারেখা নির্বাচন করার? তুমি কে হে শাসন মাটি থেকে,  ভূমি থেকে উচ্ছেদ পর্ব শুরু করার?

যে শাসক নিজেই আমাদের করের টাকায় খায়,  বিদেশ ভ্রমণ করে, দামী দামী স্যুট বুট পরে, বর্ষা- গ্রীষ্ম-শীতের পরিশ্রম করা ফসলে মোচ্ছব করে--- সে বলে শাসনের আইন? দেশপ্রেমের কথা? সে বলে কাগজ পত্রের কথা?

কে দিল তোমাকে এ অধিকার রাষ্ট্র? মানুষ,  মানুষ আর মানুষ... যারা অতি সাধারণ,  অতি অতি অতি সাধারণ --- তারাই...

4 comments:

  1. এটাই তো বক্তব্য

    ReplyDelete
  2. CAA প্রায় ৩ পাতার। ওটা পড়ে নিলে নিজেও ভ্রমের অন্ধকার থেকে মুক্ত হওয়া যাবে আর সামাজিক উন্মাদনাও শেষ হবে। এক কথায় ভারতীয় নাগরিক দের ভয় নেই । দয়া করে সবাই আইন টা পড়ুন।

    ReplyDelete

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ