Tuesday, December 24, 2019

শুভদীপ নায়ক





ফ্যাসিবাদ : ক্ষমতার একটি রাষ্ট্রীয় অধ্যায় 





১৯৬৭ সালের অনেক আগে থেকেই আফ্রিকা হয়ে উঠেছিল বিশ্ব রাজনীতির একটা সুবিধাজনক জায়গা । বহু বছর ধরে চলে আসা ঔপনিবেশিক যুদ্ধ মানুষের সচেতন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনাকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছিল, আর সেই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশ পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে হস্তগত করল পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে ।  এরও বহু আগেই প্রায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকেই ইতালিতে জাতীয় সিণ্ডিক্যালবাদের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছিল র্্যাডিক্যাল জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় 'ফ্যাসিবাদ' । এই ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে নিহিত রাষ্ট্রভাবনার অংশ থেকে, কিন্তু অচিরেই তা বামপন্থার যাবতীয় দর্শনকে উপেক্ষা করে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক চেতনায় উত্তীর্ণ হয়, যার মূল উদ্দেশ্যই হল রাষ্ট্রের সব মানুষকে একটি একক জাতীয়তাবাদের ভাবনায় একত্রিত করা । নব্য আধুনিকতাবাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বায়নের হাত ধরে । বিশ্বায়নের আসল চেহারা, যা মানুষ বাইরে থেকে দেখতে পায় তা প্রকৃতপক্ষে সাজানো, রাজনৈতিকভাবে কৃত্রিম । পৃথিবীর অর্থনীতিতে এর ফলে একটা বড়সড় রদবদল ঘটে যায়, যার ফলে বদলে যায় সমাজতন্ত্র, উদারনীতি, সাম্যবাদ ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটা বিরাট অংশ ।

ঘটনাটা যদি এতদূর পর্যন্ত বিবেচ্য হত তা হলে রাষ্ট্র সম্পর্কে উদ্বেগের কিছু থাকত না । কারণ, ফ্যাসিবাদ হল গণতন্ত্রের এক দীর্ঘ অবক্ষয়ী অধ্যায় যা দু'একটি কথায় শেষ করা যাবে না । একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আন্দোলনে যারা সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে, তারাই নব্যগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশ গঠনে নেতৃত্ব দেয় । এই নতুন রাষ্ট্রভাবনায় তারা যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী ক্ষমতায়নকে নতুনভাবে অনুমোদন দেয়, কারণ তারা মনে করে নতুন রাষ্ট্র গঠনের জন্যে শক্তিশালী একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার । এই রাজনৈতিক পদক্ষেপে প্রথমের দিকে বিশ্ববাজারের অর্থনীতিতে তাদের অবস্থান কিছুটা ওপরে উঠে আসে । লগ্নি ও বিনিয়োগের মাত্রা বৃদ্ধি পায় । অর্থনৈতিক ফ্যাসিজমের এই বাজারগত বিনিয়োগ সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝে ওঠা খুব মুশকিল । তারা সরকারের প্রকল্প ও আইনের রূপায়ণকে চাক্ষুস দেখতে পায় । কিন্তু সাধারণ মানুষ একথা বুঝতেও পারে না, বাস্তবে যে উন্নয়ন তারা নিজেদের রাষ্ট্রে দেখতে পায়, তার আর্থিক জোগান আসে বিশ্বব্যাঙ্ক কিংবা ইন্টারন্যাশেনাল মানিটারি ফান্ডের লোনের টাকায় । এমনকী, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বাদে আইটি ইণ্ডাস্ট্রিও তৈরি হয় লোনের টাকায়, যে লোনের টাকা শেষপর্যন্ত শোধ দিতে হয় সাধারণ মানুষকে । এই অর্থনৈতিক দাসত্বের জন্ম আদতে ফ্যাসিবাদের মধ্যে দিয়েই । ফ্যাসিস্ট সরকারের একক রাষ্ট্র গঠনের জন্যে যে তৎপরতা, এবং যে অনুমোদনযোগ্য বেসরকারিকরণের রাজনীতি, তা ক্রমশ প্রতিবেশীর রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করে তোলে । এর ফলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রব্যবস্থার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এগিয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বা মার্কিন মদতপুষ্ট ক্যাপিটালিস্টিক বা ধনতন্ত্র কায়েমকারী দেশগুলির অর্থনীতির দিকে । এমন অবস্থায় সামরিক চুক্তিগুলি সাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে সরকার সামরিক অস্ত্র সহ যুদ্ধপ্রস্তুতির সামগ্রী কিনতে শুরু করে । ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অনুযায়ী তারা নিজেদের দেশকে ক্ষমতা ও প্রভাবশালী দেশগুলির সারিতে এনে দাঁড় করায় এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের জন্য পার্শ্ববর্তী দুর্বল দেশকে বা জাতিকে স্থানচ্যূত করতে চায় । কিংবা যে দেশকে সামরিক দিক থেকে আমরা দখল করতে পারছি না, অন্ততপক্ষে সেই দেশের অর্থনৈতিক রাশটা নিজেদের ক্ষমতায় টেনে রাখি । ফলে দুই দেশের বিরাট সংখ্যক মধ্যবিত্ত, নিম্ম-মধ্যবিত্ত বা গরিব মানুষেরা জীবিকা হারায় । দ্রব্যমূল্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে দেশে খাদ্যসংকট শুরু হয় । পুঁজিবাদী শ্রেণি এ সময় সাধারণ গরিব মানুষকে অল্প অর্থের বিনিময়ে পরিশ্রম করতে বাধ্য করায়, ফলে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষেরা সহজেই পরিণত হয় রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রকর্তৃক নব্যধনতন্ত্রবাদের দাসে । জিডিপি এক ধাক্কায় কয়েক শতাংশ নেমে গিয়ে দেশে বৃহত্তর অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সৃষ্টি হয় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অধিকাংশটাই যখন ইউরোপের হাত থেকে সরে গিয়ে মার্কিনদের একচেটিয়া ক্ষমতার মধ্যে এসে যায়, ঠিক সেসময় ফ্রান্সের সরকার ধনতন্ত্রের এই রাজনীতিকে বদলে দেয় নব্যধনতন্ত্রবাদে । যে কথাটা লেখার শুরুতেই বলেছি, পৃথিবীর মধ্যে আফ্রিকাকেই বেছে নেওয়া হয় রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রসার ও ক্ষমতায়নের রাজনীতি করার জন্য । সেই সময় ফরাসি সরকার কঙ্গোতে তাদের মদতপুষ্ট বুর্জোয়াদের বসিয়ে সেখানে বিনিয়োগের ব্যাপারটা জারি রাখে । কঙ্গোর সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থাটা ধীরে ধীরে চলে আসে ফরাসি সরকারের নিয়ন্ত্রণে । অপরদিকে আলজেরিয়ার সরকারকে তারা অর্থনৈতিক সাহায্য করতে লাগল যার ফলে সরকার তা সহজেই ভাগ করে নিতে পারত শ্রমজীবীদের সঙ্গে । এর ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে সহজেই একটা দেশের মানুষকে তারা পরিণত করে ফেলল আর্থিক অবস্থার দাসে কিংবা সস্তা মজুরে । এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলে ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদের ক্রয়ের অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণে আনে । তারা প্রকৃতপক্ষে চায় সংগঠিত মানুষ তৈরি করতে এবং একইসঙ্গে ভোগ-মনস্ক সমাজের জন্ম দিতে পারে যা শেষ অবধি জন্ম দেয় টেকনোক্র্যাটিক দাসত্বের । অর্থাৎ, এমন মানুষ যাদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবে অন্যদের আকাঙ্ক্ষার ছাঁচে । এ এক ধরণের কৃত্রিম আশাবাদ, যা সমাজকে বদলে দিতে চায় নিছক ভোগীর সমাজে । যার মধ্যে এসে পড়বে ধর্মীয় সংগঠনগুলো, বেআইনি আর্থিক সংস্থাগুলো, এবং সর্বপরি সেইসব সরকারি অনুমোদনযোগ্য এক শ্রেণির কর্পোরেট সংস্থাও এতে জড়িত থাকবে,  যা সহজ কিছু বেতনে শিক্ষিত মানুষকে টেকনোক্র্যাটিক দাসত্বের কাজে লাগাতে পারে ।

১৯৬৭ সালের কথা দিয়ে লেখাটার সূচনা করেছিলাম, তার কারণ পুঁজিবাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতেই এই সময়ে বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন চে গুভ্যেরা । যিনি তাঁর শৈশবস্থা থেকেই ল্যাটিন আমেরিকার একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্যঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে মানুষের দুর্দশার ছবিটা নিজে চোখে দেখেছেন । সেইসঙ্গে স্পেনের গৃহযুদ্ধের বিপ্লবীদের তিনি নিজের বাড়িতে দেখেছিলেন । বুঝেছিলেন, ফ্যাসিজম ও ঔপনিবেশকতাবাদ বিশ্বায়নের হাত ধরে উন্নতির নামে সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে  অনগ্রসর দেশগুলিতে দারুণ অর্থনৈতিক শোষণ আনতে চলছে । এই আর্জেন্টিনীয় মার্ক্সবাদী বিপ্লবী প্রথমে গুয়েতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে যোগদান করে । পরবর্তীতে বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, নিকুরাগুয়া, হাণ্ডুরাস্, কিউবা, কোস্টারিকা, কঙ্গো সহ বহু দেশে অর্থনৈতিক,সামরিক, রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেন । ১৯৬৪ সালে গুভ্যেরা 'সেকেন্ড ডিক্লেরেশান অব হাভানা'র মধ্যে দিয়ে জানান, এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষ, ভূমিহীন কৃষক, প্রাপ্যবঞ্চিত শ্রমিক, ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে । কিউবাতে কাস্ত্রো যে বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন, চে নিজস্ব বিপ্লবকে তার মধ্যে মিশিয়ে দেন । '৬৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবটা জারি থাকে ।
 
সারা পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিস্ট শাসকদের পরিচয় ও পরিণতি পৃথক পৃথকভাবে হলেও তাঁদের শোষণ ও শাসনের ছবিটা একইরকম ছিল । ভার্সাই চুক্তির পরে অ্যাডলফ হিটলার জার্মানীর অর্থনৈতিক অবস্থাকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যায় । কিন্তু সেইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে শুরু হয় জাতি বৈষম্য । নাৎসি পার্টি কর্তৃক অগণতান্ত্রিক অত্যাচার ও ইহুদিদমন জার্মানির অভ্যন্তরে বিদ্রোহের সূচনা করে । ইতালির মুসোলিনি থেকে শুরু করে রাশিয়ার স্তালিন, এদের প্রত্যেকের একনায়কতন্ত্রের বহু উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে লিখিত আছে । সাধারণ মানুষ থেকে লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী সকলেই ফ্যাসিস্ট সরকারের কোপের মুখে পড়েন । নাৎসি পার্টির অত্যাচারে বাড়ি ছাড়েন সিগমুণ্ড ফ্রয়েড, আইনস্টাইনের মতো ব্যক্তিবর্গরা । নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় প্রচুর তরুণ ইহুদি লেখককে । ক্যাম্পে বিষাক্ত ইঞ্জেকশান প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয় অনেক মানুষকে । মহিলারা পর্যন্ত যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন । অপরদিকে লেনিনের মৃত্যুর পরে নিকোলাই বুখারিনকে জেলবন্দি করে তাঁর পুরো পরিবারকে নির্বিচারে হত্যা করে স্তালিনের সরকার । একাধিক রুশ লেখক ও কবিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়, কিংবা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় । জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, রাশিয়ার স্তালিন ছাড়াও চিলির অগ্যস্ত পিনোশে, জিম্বাবোয়ের রবার্ট মুগাবে, লিবিয়ার ইদি আমন দাদা, মুয়াম্মর গদ্দাফি, মিশরের হোসনি মুবারক, টিউনিশিয়ার বেন আলি, থেকে শুরু করে প্রমুখ ফ্যাসিবাদী সরকারের অত্যাচারের ইতিহাস আমাদের শাসকের চরিত্র সম্পর্কে সাবধান করে । এমনকী কম্যুনিস্ট চীনেও ম্যাডাম মাওয়ের নতৃত্বাধীন রেডগার্ড বাহিনী রাজপথে প্রচুর লেখকের বইপত্র পুড়িয়ে দেয়, আগুন লাগায় লাইব্রেরিগুলিতে, ঠিক যেমন ফ্রয়েডের বইপত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলেছিল নাৎসিবাহিনীরা, তেমনই ।

বিশ্ব ফ্যাসিজমের যে ঢেউ পাশ্চাত্য পৃথিবীতে মৃত্যুমিছিলের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তার ঢেউ এসে লেগেছে পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষেও । কিন্তু জার্মানদের ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রগতিশীল হয়ে ওঠা, কিংবা ইহুদিদের হিটলারবিরোধী হয়ে ওঠার সঙ্গে ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক সচতনতাকে মিশিয়ে দিলে জিনিসটা ভুল ভাবে । কার্যত, ভারতবর্ষে ফ্যাসিজমের চেহারা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোগত হলেও তার স্বরূপটা বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের চেয়ে আলাদা । কারণ, ভারতবর্ষ হল বহুত্ববাদের দেশ । এখানে সমগ্র দেশের মানুষ জাতীয় বৈচিত্রে ভারতবাসী হলেও, আলাদা ভাষা, পৃথক ধর্ম ও ভিন্ন সংস্কৃতিগতভাবে তারা আলাদা রাজ্যের বাসিন্দা । চারপাশে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার, বাংলাদেশ সহ শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের দেশে অনেক মানুষের ভূমি ও জন্মের টান রয়েছে । আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ব্রিটিশদের থেকে, অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার ভিতর থেকে বেরিয়ে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি । আমাদের দেশ হল গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, ভগৎ সিংয়ের দেশ । সুতরাং জাতিগত বিদ্বেষ থাকলেও জাতীয় সাম্য আমাদের আছে । সমস্যা হল এ হেন গণতান্ত্রিক দেশে সংসদীয় রাজনীতি ও সংবিধানের মধ্যে একটা সম্পর্ক বজায় রেখে তবেই দেশকে পরিচালনা করতে হয় । এবং এই ভারতীয় সংবিধানের ওপরেই নির্ভর করে এ দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি ।

ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলনের পূর্বে ফরাসি সরকার কর্তৃক 'দ্য গল'-য়ের বিদেশনীতি সম্পর্কে দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্র বলেছিলেন, 'ফ্যাসিস্ট সরকারের মূল ভিত্তিই হল একজন লোকের স্বপ্নকে জাতীয়তাবাদ ও বিদেশনীতিতে গড়ে তোলার কাল্পনিক প্রয়াস ।' ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পেলাম তদানীন্তন লোকসভা ভোটে এনডিএ ৩৫৩ টি আসন (৩০৩ বিজেপি, জেডিইউ সহ শরিক দল ৫০) থাকা সত্ত্বেও তারা বিজেপিরই সাংসদ দ্বারা মন্ত্রীসভা গঠন করল । প্রথমে আর্থিক বিল ও পরে আইনি বিলগুলোকে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই সংসদে পেশ করে পাস করিয়ে নিল । অবশ্য ক্ষমতালোভী কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল সেই বিলের সমর্থনও জানাল অন্য বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও । অপরদিকে রাজনৈতিক সমীকরণের কথা মাথায় রাজ্যসভাতেও অ-বিজেপি অ-কংগ্রেস দলের কিছু সমর্থনে সদ্য পাস হয়ে গেল সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট বিল এবং পরিণত হল আইনে । ভারতীয় সংবিধানের আর্টিক্যাল ১৪-র তোয়াক্কা না করেই সম্পূর্ণ একটি অসাংবিধানিক বিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাস হয়ে গেল । যেহেতু ধর্মীয়ভাবে ভারতবর্ষ বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত, সুতরাং বিলটিকেও সেই ধর্মের ভিত্তিতে আইনে রূপান্তর করা হল ।  যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ শুরু হল পরদিন থেকেই । টায়ার জ্বালানো, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি, দাঙ্গা, অবরোধ, জনজীবন শিথিল করে দেওয়ার সুবিধাটা গ্রহণ করতে লাগল সরকার ও ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি । কানপুর, লক্ষ্মৌ, আসাম, দিল্লি সহ প্রভৃতি জায়গায় রাষ্ট্র এই অভ্যুত্থানকে দমন করতে রাইফেলের সাহায্য নিল । পরিণাম স্বরূপ মানুষের প্রাণ গেল । যা আদতে গণবিদ্রোহের চেহারা নিচ্ছিল, তাকে থামাতে সামরিক শক্তির ব্যবহার করল একটি গণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট সরকার । কিন্তু এর শেষ কোথায় ? ইউরোপে আমরা গৃহযুদ্ধ দেখেছি, মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া লেবাননে দেখছি বর্তমান গৃহযুদ্ধের ছবি । কোরিয়াতে সামরিক অভ্যুত্থানও দেখেছি । কিন্তু ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে ভারতবর্ষের বুকে এই স্বৈরাচারী সরকারের শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ যে বড় কষ্টে আছে, সে কথা জোর দিয়েই বলতে পারি ।
ভারতে বিগত কয়েকবছরে টাকার দাম ডলারের তুলনায় পড়েছে । যেমন ভেনেজুয়েলার মুদ্রাস্ফীতি ও মার্কিন মদতপুষ্ট সরকারি সিদ্ধান্তে ধসে গেছে সেখানকার অর্থনীতি, তেমনই ভুল বিদেশনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির জেরে বারবার ধাক্কা খেতে হয়েছে বিজেপি সরকারের অধীনস্থ বর্তমান ভারতীয় অর্থনীতিকে । নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া, কিন্তু একশ্রেণির শিল্পপতিদের উপার্জন মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে । নোটবন্দির মতো ভুল সিদ্ধান্তে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংঠিত শ্রমজীবী মানুষ থেকে শুরু করে স্বল্প রোজাগারি মানুষেরা । সাধারণ মানুষের হাত থেকে চলে গিয়েছে জীবিকা । কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে না গিয়ে সরকার সিএবি-র মতো বিল পাস করে স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর পুনরায় নাগরিকত্ব প্রমাণ ও প্রদানের কথা বলছে, রাজনৈতিক মহলের মতে যা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর ।

আজ যদি সত্যিই মানুষকে লড়াই করতে হয়, তা হলে লড়তে হবে এই শ্রেণিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে, এই নব্য গঠিত ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে । লড়তে হবে রাজনৈতিক সচেতনতার দৃষ্টি দিয়ে । বাইরে কিঞ্চিৎ বহিঃপ্রকাশ থাকলেও ব্যাপারটা সেই পরিচিত পথেই এগবে । ভারতবর্ষের সরকার বিদেশনীতির মধ্যে দিয়ে দেশে মার্কিন অর্থনীতিরই আগ্রাসন ঘটাবে, এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্তরে নিজেকে বাঁচাতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার ছাতার তলাতেই গিয়ে আশ্রয় নেবে । মার্কিন সংস্থাগুলো এখনই এ দেশে ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে তুলেছে । নামমাত্র বিনিয়োগ করে তথ্য প্রযুক্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে সহজেই শিক্ষিত মানুষের একাংশকে সস্তার মজুর হিসাবে ব্যবহার করছে । এতে প্রাথমিকভাবে সরকার স্বনির্ভরতা হারাচ্ছে,  ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে মার্কিন অর্থনীতির অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে, ধাক্কা খাচ্ছে দেশীয় শিল্পগুলো । শিক্ষিতের হার গতানুগতিকভাবে বাড়লেও বেকারত্ব দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত । এ সমস্তই ঘটছে ব্যবস্থার স্বার্থে । আজ ভারতে একটি শিশু জন্ম নিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে দিয়ে । অনাহার ও দারিদ্রই তার প্রথম নিয়তি । সেটুকু কাটিয়ে ওঠবার পর তাকে লড়তে হচ্ছে রাষ্ট্র নামক এক শ্রেণিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে । সে যদি শিক্ষিত হয়, তার মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, যে রাষ্ট্রে আমার জীবন প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, তা কি বইয়ে পড়া ভারতবর্ষ ? তা কি সত্যিই ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে অর্জন করা দেশ  ? উত্তরগুলো আমাদের কারোর জানা নেই, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী এই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে একদিন তাকে পথে নামতেই হবে, অন্তত নিজস্ব দেশ নিজস্ব জন্মভূমি ও আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে ।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ