Tuesday, December 24, 2019

নুরুল হাসান






ধ্বংসাত্মক আন্দোলন ও কিছু কথা

নাগরিকত্ব সংশধোন বিল রাজ্যসভায় পাশ হবার পর, ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ কয়েকটি জায়গা হঠাত করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে হাওড়ার উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইল, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা অঞ্চলে রেল স্টেশনে প্লাটফর্মে ভাঙচুর, ট্রেনে বাসে অগ্নি সংযোগ, অবরোধ, রেল লাইনের ফিস প্লেট খুলে ফেলা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ফলে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যমে তার ভিডিও, ছবি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পক্ষে বিপক্ষে মতামতও দ্রুত তৈরি হয়।তার প্রভাব এখনো চলছে। প্রধানত আন্দোলনকারিদের পোষাক এবং দিনটির বার জুম্মাবার, শুক্রবার হওয়ার জন্য আন্দোলনকারিদের সহজেই ‘মুসলিম’ বলে সনাক্ত করাও হয়ে যায়।
কিন্তু এই মুসলিমরা কি রাজ্যের সব শ্রেণির মুসলিম, নাকি একটি মুসলিম সমাজেরই একটা পিছিয়ে পরা শ্রেণি। আমরা জানি যে, এই শ্রেণি আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি নানা বিষয় যেগুলি বৃহৎ সমাজের অংশ হয়ে ওঠার জন্য যেগুলো প্রয়োজন প্রতিটি দিক থেকেই অনেক বেশি পিছিয়ে পরেছে।  কেন পিছিয়ে পরেছে সে দীর্ঘ আলোচনা না করাই ভালো। বরং সিটিজেনসিপ অ্যামেন্টমেন্ট অ্যাক্ট এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস প্রসঙ্গে যে প্রতিক্রিয়া বা ঘটনা কয়েকটি অঞ্চল থেকে বেড়িয়ে এলো তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন অনেক মানুষই বিরোধিতা করেছেন। অনেকে শুধুমাত্রই বিদ্বেষ এর দৃষ্টিভঙ্গিতে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু হঠাত করেই একটি জনসমাজ এরকম বিধ্বংসী হয়ে উঠল কেন, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আপাতভাবে কয়েকটি কারণ আলোচনা করাই যেতে পারে।
‘আমাদের’ চারপাশ ও ‘আমাদের’ প্রতিদিনের কাজ কর্ম, ‘আমাদের’ দৈনন্দিন চিন্তা ভাবনাগুলিকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখলে উত্তর পাওয়া যাবে। মুসলিম সমাজের যে অংশ এই ধরণের আন্দোলন এর সাথে জড়িয়ে পরেছে তারা প্রতিদিন সমাজে নানা ভাবে এমনিতেই অবহেলিত। এই অবহেলা স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। কখনও পোষাক, কখনও বাংলা ভাষার উচ্চারণ, কখনও শারীরিক ভাষা, রুচি ইত্যাদি নানা কারণে সমাজে কম-বেশি কোণ ঠাসা হয়েই আছে। সেটা শুধুমাত্র এই দেশের বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠির থেকে নয়। সেটা পায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজের কাজ থেকেও। মসজিদে যাদের সাথে এক কাতারে নামাজ পরে, দাওয়াত বাড়িতে খাই, তাদের সাথেই সে ভাবে মনের মিল হয়ে ওঠে নি। বরং শ্রেণিগত বিভেদ রয়েই গেছে। চকচকে বাড়ি, বাড়ির উঁচু পাঁচিল, ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, গাড়ি ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিদিন একটু একটু করে বিভেদ বেড়ে গেছে। প্রতিদিনের বা সাপ্তাহিক জুম্বাবারের নামাজের মধ্যে কিছু ক্ষেত্র থাকলেও সেটি ওই ক্ষণিকের হয়েই থেকে গেছে। আসলে ধর্মীয় অধিকারও উচ্চশ্রেণির হাতেই রয়ে গেছে। পাড়ার জলসা, মসজিদের সংস্কার থেকে যা কিছু ধর্মীয় কাজ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাড়ার বড় লোকটি দশ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে, অন্য দিকে গরীব পরিবারটি একশ টাকা চাঁদা দিয়ে এককোণে চলে গিয়েছে। সামাজিক ভাবে এটাই স্বীকৃত। কিন্তু এই স্বীকৃতিরও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে সেই উচ্চশ্রেণি। এই ভাবেই গরীব লোকজন প্রতিদিন হয়েছে অপমানিত এবং তা নিজের ধর্মের মানুষের কাছেই।
এর সাথে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের দিকেও নজর দেওয়া উচিত। এই রাজ্যের মুসলিম সমাজের একটি অংশ আধুনিক শিক্ষা-দিক্ষায় বেশ এগিয়ে গেছে। অনেকেই চাকরি করে সরকারি বেসরকারি সংস্থায়। এই আধুনিক শিক্ষা, চাকরি সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তারা হয়ে উঠেছে বৃহৎ বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি অংশ। কথা-বার্তায়, খাদ্য রুচিতে, পোশাকে হয়ে উঠেছে ‘বাঙালি’। ফলে ধর্মীয় ভাবে যাকে ‘ভাই’ বলেছে তাদের নিয়মিত সাথ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। পাড়া প্রতিবেশী হিসেবে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভাবে উপস্থিত থাকা- এই সমস্ত কিছু থেকে একটু একটু করে দূরে চলে গিয়েছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিদিনের সাথি হয়ে উঠতে পারিনি। আমার পাড়াতে আমার নানাজি বেঁচে থাকা কালিন প্রায় প্রতিদিন এই শ্রেণির মানুষের নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো, সরকারি নানা কাজে তাদের সহযোগীতা করতো তা আমি, আমার পরিবার দেখলেও পরবর্তীতে আমরা এই যোগাযোগ গুলোই রাখিনি, ফলে সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।  কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে যেহেতু এই শ্রেণিই ভোট ব্যাঙ্ক ফলে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অংশ করে নিতে রাজনৈতিক দলগুলি দেরি করেনি। রাজনীতি থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতাও পেয়েছে সামাজিক ধর্মীয় অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও পেয়েছে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলি বৃহৎ পৃথিবীর অংশ হয়ে ওঠার মতো হয়নি কারণ, শিক্ষার খামতি। ক্ষমতাশীল দলও শুধুমাত্র কিছু ভাতা ‘দান’ এর মাধ্যমে এই সমাজের ভোট কিনতে চেয়েছে। কিন্তু এই ‘দান’ কোনো ভাবেই একটি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না, পারেও নি। বরং এই দানই পরোক্ষে এই সমাজকে বৃহৎ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল নানা ভাবে এই অপরিকল্পিত ‘দানের’ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এই বিষয়গুলি নিয়েই বিদ্বেষ ছড়িয়ে গেছে। এই বিদ্বেষ প্রতিনিয়ত মূল সমাজে থেকে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে।
অন্যদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শুধু মাত্র সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে একের পর এক আইন এনেছে। বিরোধিদের ক্ষীণ প্রতিবাদ তাদের কানেও যায় নি। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে থাকা মন্ত্রী, সংসদ মুসলিম ধর্মের মানুষকে নিয়ে একের পর এক কু মন্তব্য করেছে। কেউ ক্ষমা চাই নি বরং পরের মন্তব্যটি আরও বেশি বিদ্বেষপূর্ণ হয়েছে। একাধিক মব লিঞ্চিং হয়েছে কখনও খাদ্য, কখনও জোর করে রাম নাম বলানো ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। তার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। কিন্তু, প্রশাসনিক ভাবে সামান্য গ্রেপ্তার ছাড়া আর বড় কোনো শাস্থির কথা আমরা শুনিনি। সামাজিক মাধ্যমে ট্রেনে বাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি ক্ষেত্রে কখনও খাদ্য রুচি, কখনও পোষাক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আক্রমন হয়েই চলেছে। প্রতিবাদ করলে কুৎসিত আক্রমন এসেছে। সেখানে আইন আইনের পথে চলে নি। বরং ক্ষমতাসিন দলের নেতৃত্ব পরোক্ষে মব লিঞ্চিং এর পক্ষেই মত দিয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক ভাবে কোনো বড় বিরোধীদল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে পারে নি। শুধুমাত্রই ভোটের হিসেব নিকেশ করে গেছে। তাহলে এই শ্রেণি কীভাবে কার অবিভাবকত্বে কোন ভরসায় থাকবে, কাকে বিশ্বাস করবে? অন্য দিকে এই শ্রেণিই কিন্তু সব থেকে কম রাষ্ট্রীয় সুযোগ নিয়ে বিদেশে লেবার হিসেবে কাজ করে বৈদেশিক মূদ্রা দেশে নিয়ে আসে।
প্রকৃত বিশ্বাসী অবিভাবকের অভাব, হতাশা, প্রকৃত সহযোগিতার অভাব, শিক্ষিত মুসলিম শ্রেণির পাশ থেকে সরে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে শূন্যতা শুরু হয়। সেই হতাশারই প্রকাশ এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলন। আজ মুসলিম সমাজের একটি ছোট অংশ যে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করেছে  সেই ধ্বংসাত্মক আন্দোলন অন্য জনগোষ্টিও করেছে আগেও ভবিষ্যতেও করবে, যদি সমাজের শিক্ষিত অংশ সামাজিক দায় থেকে সরে যায়। তাদের পিছনে থাকা শ্রেণির সাথে প্রতিদিনের যোগাযোগ বন্ধ করে শুধু মাত্রই আনুষ্ঠানিক করে তোলা হয়। এই শ্রেণির মানুষের সাথে প্রতিদিনের সুখ দুঃখে অংশগ্রহণ, আধুনিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি সুযোগ সুবিধাগুলি জন্য প্রযোজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে সাহায্য করা ইত্যাদি নানা ভাবে সমাজের অংশ হিসেবে আমরা করতে পারি। না হলে সামাজিক বন্ধন থাকবে না, ভরসা থাকবে না। তারা নিজেদের বিপদগ্রস্থ মনে করলে এই রকমই আন্দোলন ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে। ফলে ভরসার হাতটুকুই এই বিপদে আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে।


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

হ্যাঁ, অন্যান্য বারের মতো সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে নয়, বরং খুব সচেতন ভাবে, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমরা এন আর সি-র বিরুদ্ধে, সি এ এ -এর বিরুদ...

পাঠকের পছন্দ