শব্দের জমায়েত
লেখার খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে
দেখছি, শব্দের
রাজপথে আজ ক্রমশই জমে উঠেছে দ্রিংচড়কের উৎসব। মাঠ জুড়ে শব্দেরা হরেকরকম বিভক্তির সাজপোশাক পরে নেমে পড়েছে। কেউ দ্বিতীয়ার ‘কে’, কেউ
ষষ্ঠীর ‘র’, কেউ সপ্তমীর ‘ে’, কেউ বা
একেবারেই নিরলংকৃত শূন্য। কয়েকটি পৃথুল ক্রিয়াবিশেষণ পিছিয়ে পড়েছিল,তারা এসে পৌঁছুল
পরে গদাইলশকরি চালে।
মিছিল ধরে দাঁড়িয়েছে সবাই,চেঁচিয়ে বলছে,‘ক্রিয়াপদ...ক্রিয়াপদ যেন লাইনে সবার শেষে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়াল এসে সবার আগে ক্রিয়া তাদের ওই কথা
শোনামাত্রই,হাতে
তার উড্ডীন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন। কয়েকটি ব্যঞ্জনাময় অলঙ্কৃত মেয়েশব্দ
হিহিহি করে হেসে ওই দেখে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল। আর দুয়েকটি যুবাশব্দ চিবুক উঁচু করে
দাঁড়িয়ে রইল অনম্র প্রতিজ্ঞায়। তাদের হাতে হাত রেখে বলিষ্ঠ কোমল দাঁড়িয়েছে রুশতী নারীশব্দ
কতগুলি সঙ্গীতমুখর। এদেরই
মাঝে মাঝে ছুটে ছুটে
অনেক ‘ও’, ‘কিন্তু’, ‘এবং’, ‘বরং’, ‘অপিচ’ ‘মিছিলের
পদযাত্রীদের সঙ্গে ক্রমাগত সংযোগ রক্ষা করে চলেছে।
ব্যাপার হচ্ছে,শব্দের ধর্ম নিয়ে,জাত নিয়ে প্রবল আন্দোলন উপস্থিত। এমন ঘটনা বা রটনা যে,তৎসম ব্রাহ্মণ
শব্দগুলিই নাকি থাকবে লেখায়,টিকে যাবে ম্লেচ্ছ ইংরেজি শব্দসমূহও আমাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সুপবিত্র
স্মৃতি হিসেবে। পর্তুগিজ বা ওলন্দাজ
শব্দ,প্রাকৃত বা পালি শব্দ আবেদন জানালে তাদের
শরণার্থী হিসেবে মেনে নিয়ে পরে নাগরিক করে নেওয়া হবে। দেশি শব্দদের নাকি মেনে
নেওয়া হয়েছে আগেই,যদিও তাদের
প্রতি নাসিকাকুঞ্চনের ভাব একেবারে
যায়নি। কে আবার কবে
কোলভিল
চাষাভুষা মুচিমুদ্দফরাসের ভাষাকে সম্মান করে! প্রয়োজনে লাগলে প্রান্তিকবর্গ
মানুষের সাহিত্যে ওদের নির্বাচন করে নেওয়া যাবে।
মুশকিল হয়েছে আরবি আর ফারসি শব্দগুলো নিয়ে। ওদের নাকি কোনো আবেদন করতে দেওয়া হবে না। ভাষাসদস্য হবার ন্যূনতম আবেদনটুকুও করতে হবে না ওদের। এবং এইভাবেই তারা
পূর্বাহ্নেই চিহ্নিত হয়ে গেলে অন্তিমে
তাদের কোথাও ডিটেইনশন ক্যাম্পে
তালাবন্ধ করে রাখা হবে কিংবা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ভাষামাঠের বাইরে বের করে দেওয়া হবে।
আরে,
শেষ অবধি তো আরবি শব্দ,ফারসি শব্দ—এরা কোথাও থেকে প্রতাড়িত হয়ে এই ভাষামাঠে ঢুকে পড়েনি। ওরা জন্মেছে আক্রমণকারী খাজাঞ্জা খাঁ-র খামখেয়ালের সন্তান হিসেবে। ওদের এখন তাড়িয়ে বের করে দেওয়াই ভালো, নয়ত ডিটেইনশন
ক্যাম্পে কিছুদিন রেখে টুঁটি চেপে মেরে ফেললেই চুকে গেল ঝামেলা।
তবে সবাইকেই প্রস্তুত রাখতে হবে কাগজপত্র,
জমির পড়চা, জন্মের রসিদ আর বাপঠাকুরদার ঠিকুজি, কুলুজি এবং প্রয়োজন হলে দেখাতে হবে
নিপীড়িত, ধর্ষিত হবার ফোটোগ্রাফ, ফরেনসিক রিপোর্ট, রক্ত-বীর্য-অশ্রুর শুকিয়ে যাওয়া
দাগ। এসব না হলে ‘শরণার্থী’ খেতাব মিলবে কেমন করে?
এই পরিকল্পনায় অন্তিমে শুধু তৎসম শব্দই থাকবে,ভাষা হয়ে উঠবে একটি তৎসমরাষ্ট্র। তৎ এখানে রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং লেখক। তিনি কাকে রাখবেন,
কাকে ফেলবেন—সবই তাঁর রাজধর্মনিষ্ঠ মেজাজ ও মর্জি।
এমন বিভেদদৃষ্টির মতলব আগাম বুঝতে পেরে সমস্ত শব্দরাই আজ লেখার
খাতায় মিছিল করে দাঁড়িয়েছে, এমনকি উচ্চবর্ণের তৎসমরা
এসেছে,হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে পালি,প্রাকৃত,মাগধী,অর্ধমাগধী,দেশি, বিদেশি,যাবনিক
সবাই। তাদের মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত শ্লোগান তুলছে ভাষাদেশে সকলে মিলেমিশে একসঙ্গে
বাস করার সমান অধিকারে। ওরা গান গাইছে,বিশৃঙ্খল চেঁচিয়ে উঠছে,শ্লোগান দিচ্ছে,দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে
স্বৈরাচারী লেখকের বিরুদ্ধে সোচ্চার
সমষ্টিগত প্রতিবাদে।
No comments:
Post a Comment