হিটলারকে লেখা গান্ধিজির চিঠি ও আমার দেশ
প্রিয় পাঠক, এই শিরোনাম কোনও কল্পবাস্তব বিষয় নয়। সত্যি
সত্যিই হিটলারকে লেখা গান্ধিজির একাধিক চিঠি আছে। তার মধ্যে একটি ব্যক্তিগত চিঠি। একটি খোলা চিঠি। অন্তত এই
দুটি চিঠির কিছুটা অংশ আপনাদের কাছে তুলে ধরব, সেখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাবে
পৃথিবীর ইতিহাসে জন্মগ্রহণ করা অহিংসপথের অন্যতম যাত্রী,
(এমনকি ভবিষ্যত পৃথিবী বিশ্বাস নাও করতে পারে যে এমন একজন মানুষ সত্যিই জন্মেছিলেন
এই পৃথিবীতে) তিনিও হিটলারের মতো নরখাদকের নখে লেগে থাকা রক্তের সুস্পষ্ট চিহ্ন
দেখতে পাননি।
সারা জীবনের
সাধনাকে শুধু এই কয়েকটি চিঠির বাস্তবতায় বিচার করলে যদিও ভুল হবে, তবু এটিও ঠিক যে
হিটলার সম্পর্কে গান্ধিজি রাজকুমারী অমৃত কাউর’কে ১৯৪০-এর মে মাসের মাঝামঝি লেখা
একটি চিঠিতে যে কথা বলছেন, যে যুক্তিতে হিটলারকে প্রায় ডেমি-গডের উচ্চতায় স্থাপণ
করছেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে, এই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাসে-ট্রেনে ঠিক একই
যুক্তিতে এনআরসি-সিএএ-ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশে গুলিচালনাকে
সমর্থণ করতে শুনেছি প্রচুর মানুষকে।
এই
মানুষগুলিই ফ্যাস্টিস্টদের পথ করে দেয়। এবং সব থেকে আশ্চর্যের কথা, মাঝে মাঝে এই
সব ফ্যাসিস্ট-গন্ধী কথা বলা মানুষগুলির মুখ পালটে গিয়ে অবিকল আমাদের মুখ হয়ে ওঠে।
ফ্যাসিস্টের হাত শক্ত করবার পিছনের যুক্তিগুলি থেকে যায় একই।
রাজকুমারী
অমৃত কাউরকে সেই ‘বিখ্যাত’ চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘I do not
consider Hitler to be as bad as he is depicted. He is showing an ability that
is amazing and he seems to be gaining his victories without much bloodshed’.
এখানে লক্ষণীয়, ১৯৪০ সালের মে মাসে গান্ধিজির শ্রদ্ধাভক্তি হিটলারের প্রতি অটুট। যতটা খারাপভাবে তাকে ফুটিয়ে তোলা হয় তিনি আদপে ততটা খারাপ নন। এমনটাই গান্ধিজির মত। ইতিহাসের কী পরিহাস, তিনি উত্তর পাবেন না জেনেও, গান্ধি একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখছেন হিটলারক। সেটি ১৯৩৯ সাল, জুলাই মাস। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে সে চিঠির ভাষার সামনে দাঁড়িয়ে। বারবার মনে হয়, ইতিহাস কি সমসময়ে দাঁড়িয়ে
এতটাই প্রতারক হয়ে ওঠে কখনও কখনও! না হলে গান্ধিজির মতো মানুষ
ভক্ষকের কাছ থেকেই আশা করছেন রক্ষকের রাজধর্ম! পৃথিবীর
ইতিহাসে সব থেকে বেশী মানুষ মারার কারিগর যে, তাকেই চিঠি
লিখছেন সভ্যতার ইতিহাসে সব থেকে অহিংস মানুষ এই ভাষায়,
‘Friends have been urging me to write to you for the sake of humanity. But
I have resisted their request because of the feeling that any letter from me
would be impertinence. Something tells me that I must not calculate and that I
must make my appeal for whatever it is worth.
It is quite clear that you
are today the one person in the world who can prevent a war which may reduce
humanity to the savage state.’
-এর থেকেও ‘ভয়ংকর’ মনে
হয়েছে ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে তাঁর লেখা হিটলারকে খোলা চিঠিটি,
‘…I hope you will have time and desire to know how a good portion of
humanity who have been living under the influence of that doctrine of universal
friendship, view your actions. We have no doubt about your bravery or devotion
to your fatherland, nor do we believe that you are the monster described your
opponents…’
-এই চিঠি পড়ে যদি কেউ এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে গান্ধিজি তলে তলে
ফ্যাসিজমের সমর্থক ছিলেন বা হিটলার ‘সহিংস’ পথ তাঁর বেজায় ভালোলাগার বিষয় ছিল, তবে সেটা অন্ধের হস্তিদর্শন
হয়ে উঠবে।
শুধু তাকিয়ে দেখার
আর চিন্তায় ডুবে যাওয়ার বিষয় এটাই যে গান্ধিজির মতো নিজের-সময়ের থেকে অন্তত পাঁচশো বছর এগিয়ে থাকা একজন মানুষকেও ‘bravery’ ও ‘devotion to
fatherland’ বিষয় দুটি কীভাবে প্রতারণা করতে পারে। ইতিহাসের সব থেকে ইস্পাত-কঠিন মানসিকতার একজন মানুষ যদি অবচেতনে জাতীয়তার প্রশ্নে জার্মানির প্রতি হিটলারের
‘অবদান’কে অস্বীকার না-করার
উপাদান বহন করেন তাহলে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে যে এই আফিমটি সহজেই ‘গিলিয়ে’ দেওয়া যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
চিঠি’টিতে প্রায় সেই সুরেই হিটলারকে
গান্ধিজি ‘আপনি ঠিক ততটা দুষ্টু লোক নন’ বলেছেন যে সুরে সমর্থকরা ফ্যাসিস্টের যাবতীয়
কাজকে ‘ওসব দুষ্টু লোকের অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিতে পছন্দ করে।
২
চিরকালই এই ‘ব্রেভারি’ ঘনিয়ে ওঠা ফ্যাসিজমের মিনি-রূপগুলির থেকে আমাদের নজর ঘুরিয়ে
দেয়। আমাদের সংস্কার, রাজশক্তির প্রতি আমাদের সমর্থণ জানাবার অভ্যাস আমাদের প্রশ্ন
করতে ভুলিয়ে দেয়।
প্রিয় কবি গৌতম চৌধুরী অতি-সম্প্রতি
‘আগোছালো দু’চার কথা’ নামে এক বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বারণাবতে এক নিষাদ রমণী
ও তাঁর পাঁচ-পুত্রের পুড়ে যাওয়া শরীরের উপর দিয়ে পাঁচজন রাজপুরুষ হেঁটে গিয়েছিলেন।
এভাবেই হয়তো চিরকাল দলিতের পোড়া শরীরের উপর দিয়ে রাজপুরুষেরা হেঁটে যায়।’
-রাজপুরুষদের কাছে সব থেকে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে ধর্ম। রাষ্ট্র ও ধর্মের গাঁটছড়া
বেঁধে দেওয়া ফ্যাসিস্ট শক্তির সব থেকে বড় উদ্দেশ্য। একবার এই কাজটি করে ফেলতে পারলে
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় না তাকে। তার সব কাজই কেমন যেন ‘জাস্টিফায়েড’ হয়ে যায় তখন।
এবং এই জাস্টিফিকেশন দেয় তারাই যারা এক কাল্পনীক ভয়ে ঢুকে পড়তে চায় ফ্যাসিস্টের ‘আশ্রয়ে’।
এই ভয় সৃষ্টি করবার সব থেকে
নরম মাটির নাম ‘ধর্ম’। এই কাজটি করতে গেলে প্রথমেই সংস্কৃতি ও ধর্মের দুটি পৃথক ধারণাকে
গুলিয়ে দেওয়া আবশ্যক। আমাদের দেশ হাজার হাজার বছর ধরে যে সংস্কৃতি অর্জন করেছিল তাকে
ধর্মের কাছাকাছি এনে ফেলার কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। আজ তা ফুলে-ফলে বিষগাছে দুলছে।
আজ যে শক্তি শাসকের ভূমিকায়
তাকে কিন্তু কোনও মঙ্গলগ্রহের ‘ভোটমেশিন’ নির্বাচিত করে আনেনি। তাকে নির্বাচিত করেছি
আমরাই। সারা পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থার রমরমা ও ইসলামোফবিয়ার জুজু তৈরী হবার পিছনে অনেক
অনেক কারণ রয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে, আমাদের বাংলায় এই জুজু তৈরী হবার পিছনে রয়ে
গেছে সাদ্দাম-কোট রাস্তার মোড়ে মোড়ে শনিকালী মন্দিরের প্রণামীবাক্সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে
‘আলোকপ্রাপ্তদের’ টাকা গুঁজে দেওয়া তসলিমা নাসরিনের বিতাড়নের মতো ছোটছোট ঘটনাও।
পাড়ায় পাড়ায় ‘কমরেড’দের এক সময়
সাদ্দাম-কোট পরে আমেরিকাবিরোধী ভাষণ দিতে শুনেছি। খুল্লামখুল্লা সাদ্দাম-সমর্থণ ছিল
তাদের গলায়।
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে শনিকালী
মন্দিরে টাকা গুঁজে দিতে দেখেছি সিপিএম-কংগ্রেসের ‘প্রগতিশীল’ অংশকে। আজানের সময় মাইকে
বিপ্লবের কথা বন্ধ রেখে খৈনী-পাকাতে দেখেছি আগুনখোর বিপ্লবীকে। এবং এটি ঘটত বেছে বেছে
মুসলিম মহল্লাগুলিতেই। আজ বুঝি, সে সময়ে ঐ মিটিং-এ উপস্থিত থাকা আমরা সকলেই আসলে একটু
একটু করে এই শক্তিকে পথ দেখিয়েছি। এক ভণ্ডামি পথ করে দিয়েছে আরেক ভণ্ড-শক্তিকে।
পাকিস্তানের এক তরুণ যখন ধর্মদ্রোহীতার কারণে মৃত্যুদণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে তখন ভার্চুয়াল
মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। কিন্তু আমরা সমাজের কত অংশ? আমরাই তো সেই মানুষ যারা শরণাগতের ‘স্বাভাবিক
পালনীয় কিছু আচরণের’ অজুহাতে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে কলকাতায় গুন্ডামি রুখতে পারিনি।
তসলিমা বড় কোনও লেখিকা নন। কিন্তু যে অজুহাতে তাঁকে তাড়ানো হয়েছে তাও সভ্যতা বিরোধী।
যদি আমরা তসলিমার বিতাড়নকে এক শতাংশ’ও সমর্থণ করি, তা হলে পাকিস্তানের জুনেইদের প্রাণদণ্ডের
বিরুদ্ধে আমাদের কথা বলবার কোনও অধিকারই থাকতে পারে না।
একটি শক্তি এসব দেখেছে আর ঠোঁট
চেটেছে। তাদের সুযোগ করে দিয়েছে আরও কিছু শক্তি। মেরুকরণের দিন শুরু হয়েছিল অন্তত পঞ্চাশ
বছর আগে। মাঝে ঘটে গেছে শিখবিরোধী দাঙ্গার মতো বিষয়।
ইতিহাসের খেলা এটাও। যে শক্তি
১৯৮৪ সালে দিল্লীর রাস্তায় নির্দোষ শিখদের গলায় জ্বলন্ত টায়ার পরিয়ে খুন করেছিল সেই
শক্তিই আজ প্রধাণ বিরোধী শক্তি। আজ দেশের প্রধাণমন্ত্রী যখন প্রতিবাদীদের চিনে নেবার
জন্য তাদের পোশাকের দিকে তাকানোর মতো ঘৃণ্য কথা বলেন, তখন মনে পড়ে যায় দিল্লীর রাস্তায়
শুধু পাগড়ি আর দাড়ি দেখে শিখদের জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটিও ছিল সংখ্যালঘু নিধন।
কিন্তু আজকের শাসকের সামনে আরও
বড় মৃত্যুভূমি জয় করার অপেক্ষায় পড়ে আছে। কারণ দেশের দুই ‘প্রধাণ’ ধর্মের মানুষকে প্রায়
লড়িয়ে দেওয়া গেছে।
এক্ষুনি প্রতিরোধ শুরু না-হলে
আরও বড় বিপদ ঘটে যাবে। রাস্তায় নামুন। গলা মেলান প্রতিবাদে-প্রতিরোধে। যে দল (বা দলগুলি)
মানুষকে ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে ব্যবহার করে তাদের ছুড়ে ফেলে দিন। মৌলবাদের বিরুদ্ধে মৌলবাদকে
প্রশ্রয় দেওয়া অপরাধ। ফ্যাসিস্ট এটাই চায়।
যদিও আমার বিশ্বাস আমাদের দেশ
পুরোদস্তুর ফ্যাসিজমের দখলে চলে যাবার সম্ভাবনা কম। তার পিছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে,
সে এক পৃথক আলোচনার বিষয়। শুধু বলে রাখা ভালো, আমাদের দেশের কোটি কোটি ‘নিম্নবর্গীয়’
মানুষের জীবনবোধ ও জীবনদর্শন যে সুউচ্চ ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত তা সম্ভবত পৃথিবীর আর
কোনও ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে ততোটা প্রবল নয়। বরং এ সময়ে দাঁড়িয়ে কোটি কোটি ‘মধ্যবিত্ত’
মানুষ, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই ফ্যাসিজমের প্রচ্ছন্ন সমর্থক ধারক ও বাহক। সক্রিয়
প্রতিরোধ ছাড়া এ শক্তিকে রোখা যাবে না।
যদিও আমার এই ধারণাও ভুল প্রমানিত
হতে পারে। ইতিহাস দেখিয়েছে, হিটলারের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে গান্ধিজির হিমালয়-সম ভ্রান্তি।
আমার মনে হয় তুলসীদাস-কবীরের দেশে এবার একটু একটু করে অপশক্তিকে রুখে দিচ্ছে মানুষ।
প্রতিরোধ তীব্র হচ্ছে।
আবার এটিও দেখা যেতে পারে যে, এই লেখা লেখার সময়ে হয়তো পুরোদস্তুর ফ্যাসিজমের গহ্বরেই
চলে গিয়েছিল আমার দেশ।
আমরা বুঝতেই পারিনি।
তথ্যসূত্র – The Life and Death of Mahatma Gandhi / Robert Payne
No comments:
Post a Comment